এই মুহূর্তে




প্রত্যেকটি রথ বিভক্ত ৩৪টি ভাগে – জেনে নিন অজানা তথ্যাবলী




পৃথ্বীজিৎ চট্টোপাধ্যায় :  “নীলাচল নিবাসায় নিত্যায় পরমাত্মনে। বলভদ্র সুভদ্রাভ্যাং জগন্নাথায় তে নমঃ॥”

দেখতে দেখতে সুস্থ হয়ে উঠছেন মহাপ্রভু জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। অনেক কবিরাজি পাচন খাওয়ানো হয়েছে। মুখে রুচিও ফিরেছে। টানা ১৫ দিন অনাবসরে থাকার পর এবারে সময় হয়ে এসেছে মাসির বাড়ি যাওয়ার। এই চলতি সপ্তাহে শুক্রবার অর্থাৎ ২৭ জুন লীলাপুরুষোত্তম শ্রী শ্রী জগন্নাথের রথযাত্রা। জানা যায়, রথযাত্রা ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহত্তম ধর্মীয় মহোৎসব, যা মূলত প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে পালিত হয়। এই উপলক্ষে ভগবান জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার জন্য নির্মিত হয় তিনটি বিশেষ সুবিশাল রথ। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী রথগুলির কাঠ সংগ্রহ করা হয় শুধুমাত্র ফাসি ও ধৌসা গাছ থেকে, যা মহানদী বেয়ে ভেলায় ভাসিয়ে আনা হয় পুরীর উপকণ্ঠে। এরপর সেগুলি শ্রীমন্দির এলাকায় নিয়ে গিয়ে দক্ষ ছুতোররা রথ নির্মাণ করেন, যাঁরা পূর্বতন দাসপল্লি রাজ্যের বংশপরম্পরায় এই কাজের অধিকারী।

পুরাণ মতে, এই দিনে জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রা মাসির বাড়ি অর্থাৎ গুন্ডিচা মন্দিরে যান এবং সেখানে সাতদিন অবস্থান করেন। সেই যাত্রাকে “সোজা রথ” এবং মন্দিরে প্রত্যাবর্তনকে “উল্টো রথ” বলা হয়। তিনটি রথই চমৎকারভাবে অলঙ্কৃত হয় এবং ভক্তরা দড়ি টেনে সেই রথ টানেন। এই উৎসব শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নয়, বরং সমগ্র ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন। শ্রী শ্রী জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার তিনটি রথের নকশা, কাঠামো, রং ও অলংকরণে রয়েছে পৃথক বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য।

১. নন্দিঘোষ – জগন্নাথদেবের রথ

মহাপ্রভু জগন্নাথের রথের নাম নন্দিঘোষ। এই রথ নির্মাণে ব্যবহৃত হয় ৮৩২টি ছোট-বড় কাঠের টুকরো। উচ্চতা ১৩.৫ মিটার। একসময়ে এর ১৮টি চাকা থাকলেও বর্তমানে তা ১৬টিতে রূপান্তরিত হয়েছে। হিন্দু ধর্মে এই ১৮ চাকার ব্যাখ্যা হল অষ্টাদশ সিদ্ধির প্রতীক। রথের চুড়োয় থাকে ‘ত্রৈলোক্যমোহিনী’ নামে বিশেষ ধ্বজা। নন্দিঘোষ রথের দ্বাররক্ষী হিসেবে রয়েছেন ব্রহ্মা ও ইন্দ্র।

জগন্নাথদেবের রথের প্রধান পার্শ্বদেবতা হলেন: বরাহ, গোবর্ধন, গোপীকৃষ্ণ, নৃসিংহ, রাম, নারায়ণ, ত্রিবিক্রম, হনুমান ও রুদ্র। এছাড়া মুনি-ঋষিরাও রয়েছেন, যেমন: নারদ, দেবল, ব্যাসদেব, শূক, পরাশর, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র ও মারিচি। এঁরা সবাই ধ্যানরত অবস্থায় রথে উপবিষ্ট।

নন্দিঘোষের রং লাল-হলুদ (হলুদ অনেকটা সোনালি)। রথের চারটি ঘোড়ার নাম: সংখ, বলাতক, শ্বেত ও হরিদাক্ষ। সারথির নাম মাতলি। রথের নিচের অংশে কলসের নাম ‘হিরণ্ময়’, যার মাধ্যমে মঙ্গল কামনা করা হয়। রথের প্রধান রক্ষক গরুড়।

২. তালধ্বজ – বলরামের রথ

বলরামের রথের নাম তালধ্বজ। রথটির উচ্চতা ১৩.২ মিটার এবং ৭৬৩টি কাঠের টুকরো লাগে এর নির্মাণে। রথের রং লাল-সবুজ। চূড়ায় ‘উন্মনী’ নামের ধ্বজা থাকে। বলরামের রথে সুদর্শন চক্রের পাশে দু’টি পাখি (কাকাতুয়া) স্বধা ও বিশ্বাস অবস্থান করে।

এই রথে বলরামের পার্শ্বদেবতা হলেন: গণেশ, কার্তিক, সর্বমঙ্গলা, প্রলম্ব, হলযুধ, মৃত্যুঞ্জয়, মহেশ্বর ও শেষদেব। দ্বাররক্ষী হিসেবে রয়েছেন রুদ্র ও সাত্যকি। সারথির নাম দারুক। রথের চারটি ঘোড়া— তীব্র, ঘোর, শ্রম ও দীর্ঘ। তালধ্বজের মোট চাকার সংখ্যা ১৪টি (পূর্বে থাকত ১৬টি )।

৩. দেবদলন – সুভদ্রার রথ

দেবী সুভদ্রার রথের নাম দেবদলন বা দর্পদলন । উচ্চতা ১২.৯ মিটার। রথ নির্মাণে ব্যবহৃত হয় ৫৯৩টি কাঠের টুকরো। চাকা রয়েছে মোট ১২টি (পূর্বে থাকত ১৪টি )। চূড়ায় ‘নাদম্বিক’ নামে ধ্বজা থাকে। সুদর্শন চক্রের পাশে থাকে দুটি পাখি— শ্রুতি ও স্মৃতি।

সুভদ্রা মূলত এক তান্ত্রিক দেবী রূপে পূজিতা হন। তাই তাঁর পার্শ্বদেবতারা হলেন: চণ্ডী, চামুণ্ডা, উগ্রতারা, বনদুর্গা, শূলিদুর্গা, শ্যামাকালী, মঙ্গলা, বরাহি ও বিমলা। দ্বাররক্ষী হলেন ভূদেবী ও শ্রীদেবী। রথের উপর ভৈরবরা উপবিষ্ট। সারথির নাম অর্জুন। রথের চারটি ঘোড়া— রচিকা, মোচিকা, জিতা ও অপরাজিতা।

প্রত্যেকটি রথ ৩৪টি ভাগে বিভক্ত। তলদেশ থেকে ওপরে— চাকা, ডাণ্ডিয়া, আরা, বেকি, হংসপট, কানি, শঙ্খদ্বার, জালি, গইপট, সিংহাসন, রুশিপট ইত্যাদি। রথের শীর্ষে থাকে কলস, তার উপর সুদর্শনচক্র এবং সবশেষে ধ্বজা।

নিঃসন্দেহে বলা যায়, পুরীধামের রথযাত্রা শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং ভারতীয় সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের এক বিস্ময়কর নিদর্শন। মহাপ্রভু জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার রথের আলাদা অলংকরণ, নকশা ও প্রতিটি অংশের নিজস্ব তাৎপর্য এই উৎসবকে আরও মহিমান্বিত করেছে। সারা বিশ্বের ভক্তরা এই রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করে নিজেদের ভাগ্যবান বলে মনে করেন। জয় জগন্নাথ।




Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

ফাঁকা ট্রেনে মহিলাকে গণধর্ষণের পর ছুঁড়ে ফেলা হল চলন্ত ট্রেনের সামনে, নারকীয় ঘটনা হরিয়ানায়

‘ড্রিমলাইনার সবচেয়ে নিরাপদ’, বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে সংসদীয় সমিতিকে সাফাই এয়ার ইন্ডিয়ার

বিহারে সরকারি চাকরিতে মেয়েদের ৩৫% সংরক্ষণ! মহিলা ভোট টানতে নয়া চাল নীতীশের

দিনহাটার বাসিন্দা উত্তম কুমার ব্রজবাসীকে NRC নোটিশ, ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী

ভূত তাড়ানোর নামে মাকে পিটিয়ে মারল ছেলে

তামিলনাড়ুতে রেললাইন পার হওয়া স্কুলবাসে ট্রেনের ধাক্কা, ৩ শিশুর মৃত্যু

Advertisement




এক ঝলকে
Advertisement




জেলা ভিত্তিক সংবাদ