নিজস্ব প্রতিনিধি: গঙ্গাপ্রসাদ সেন/ কবিরাজি করিতেন / এই ভদ্রাসনে বসি। দেশবিদেশের রুগী/ রাজা প্রজা ফিরিঙ্গী/ গৃহে তাঁর জুটিতেন আসি। ১৭, কুমোরটুলি স্ট্রিটের একদম শেষের দিকে গেলে একটি বাড়ির প্রবেশদ্বারের বাঁ দিকে ধন্বন্তরী নামে কবিতায় এই লাইনগুলি চোখে পড়বে। এই বাড়িটিই কবিরাজ গঙ্গাপ্রসাদ সেনের। তাঁর আরও একটি পরিচয় রয়েছে, ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের চিকিৎসক হিসাবে। তবে সেই দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার আগের বছরেই কুমোরটুলির বাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন তিনি। সালটা সম্ভবত ১৮৪১। পরের বছর রামকৃষ্ণদেব অসুস্থ অবস্থাতেই তাঁর বাড়ির পুজো দেখতে এসেছিলেন। আর সেই বছর থেকেই সেন বাড়ির পুজোর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দুই বাংলার সর্বত্র।
১৭ শতকে পূর্ববঙ্গে ঢাকার প্রসিদ্ধ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ছিলেন কবিরাজ নীলাম্বর সেন। পরে পরিবার নিয়ে কলকাতার কুমোরটুলিতে আসেন তাঁরা। ছেলে গঙ্গাপ্রসাদ এখানেই তাঁর কবিরাজি শুরু করেন। দিনে দিনে তাঁর খ্যাতি বাবাকেও ছাপিয়ে যায়। দেশ বিদেশের সাধারণ মানুষ, রাজা-উজির, এমনকী সাহেবরাও এই গঙ্গাপ্রসাদের শরণাপন্ন হয়েছেন কোনও না কোনও সময়ে। দক্ষিণেশ্বরে সাধনকালের প্রথম অবস্থায় রানী রাসমণির জামাতা মথুরবাবুর আহ্বানে তিনি রামকৃষ্ণের চিকিৎসার ভার গ্রহণ করেছিলেন। বলা হয়, চিকিৎসাশাস্ত্রের আয়ত্তের বাইরে ঠাকুরের অলৌকিক লক্ষণগুলি নিরাময় করতে ব্যর্থ হয়ে কবিরাজ দুর্গাপ্রসাদ এই ব্যাধিকে ‘যোগজ ব্যাধি’ বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু গঙ্গাপ্রসাদ হাল ছাড়েননি। সেকালে কবিরাজি করেই তাঁর এত পসার হয়েছিল যে সেই অর্থে তিনি ট্রাস্ট স্থাপন করে গিয়েছিলেন। আজও সেই ট্রাস্টের অর্থের একাংশ দিয়েই পুজোর যাবতীয় খরচ করা হয়।
সেন বাড়ির প্রতিমা একচালার। ডাকের সাজে মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমায় কার্তিক-গণেশের স্থান ভিন্ন। ঋদ্ধি-সিদ্ধি-বুদ্ধির দেবতা গণেশ সাধারণত মায়ের ডানদিকে লক্ষ্মীর সঙ্গে থাকেন। বাঁদিকে থাকেন শৌর্য–বীর্যের দেবতা কার্তিক, সঙ্গে সরস্বতী। গঙ্গাপ্রসাদ সেনের বাড়িতে এর উল্টোটাই দেখতে পাবেন। পুজো হয় ‘কালিকাপুরাণ’ পুথিমতে ‘নবম্যাদিকল্প’ অনুযায়ী। অর্থাৎ, ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথি থেকে আরম্ভ হয় বোধন, ষষ্ঠীতে অধিবাস। চালকুমড়ো, আখ বলি হয় এখানে। তবে এই পুজোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি হল, অষ্টমীর রাতে দুর্গার সঙ্গে কালীপুজোও হয়, সেই সঙ্গে শীতলা-কালীর ঘট বসিয়েও পুজো করা হয়। তবে আজও রীতি মেনে সেনবাড়িতে নিত্যপূজো পান লক্ষ্মী, গোবিন্দ এবং নারায়ণ।