নিজস্ব প্রতিনিধি: বাম জমানার ৩৪ বছরে বাংলা জুড়ে গণহত্যা আর গণধর্ষণের ঘটনা কার্যত ব্রিটিশদের অত্যাচারকেও হার মানিয়েছিল। সেই সব লালসন্ত্রাসের নিদর্শনের অন্যতম ছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতার বুকে ঘটে যাওয়া ছোট আঙাড়িয়ার গণহত্যাকাণ্ড। গুলি করে, আগুনে পুড়িয়ে সেদিন খুন করা হয়েছিল ৫জন তৃণমূলকর্মীকে। তাঁদের মধ্যে একজনের গলা কেটে ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল খুনিরা। সেই ঘটনা রাজ্য রাজনীতিতে তো বটেই দেশজুড়ে তীব্র চাঞ্চল্য ছড়িয়ে দিয়েছিল। ২০০১ সালের ৪ জানুয়ারিতে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার প্রধান সাক্ষী ছিলেন বক্তার মণ্ডল। তাঁর বাড়িতেই সেদিন লালপার্টির হার্মাদরা হামলা চালিয়ে ছিল। সেই বক্তার এবার থেমে গেলেন। জীবনের দৌড়ে হার মানলেন। রবি সকালেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। যদিও তাঁর সাক্ষী আদালতে থেকে গিয়েছে। মানুষ জানতে পেরেছে লালপার্টির লালসন্ত্রাস কাকে বলে।
ছোট আঙাড়িয়া নিয়ে তৃণমূলের অভিযোগ ছিল, সিপিআই(এম) এর হার্মাদবাহিনী সেই সময়কার জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর ঘাতক বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে অপারেশন চালিয়েছিল। ওই ঘটনায় অভিযুক্ত হন রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রী তথা গড়বেতার বিধায়ক সুশান্ত ঘোষ, সিপিআই(এম) এর তৎকালীন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জেলা সম্পাদক দীপক সরকার, এলাকার দুই দাপুটে সিপিআই(এম) নেতা তপন ঘোষ ও সুকুর আলি এবং দিল মহম্মদ সহ আরও ৩ নেতা। সেদিনের ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন যে ৫ তৃণমূল কর্মী তাঁরা হলেন – মোক্তার খাঁ, রবিয়াল ভাঙি, হায়দার মণ্ডল, মুক্তো পাত্র ও জয়ন্ত পাত্র। এদের দেহের সন্ধান আজও মেলেনি। অভিযোগ ছিল ঘটনার পরে ৫জনের দেহ পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বাড়ি থেকে রাতের আঁধারে বের করে গড়বেতার জঙ্গলে পুঁতে দেওয়া হয়। সেই ঘটনায় সিবিআই তদন্তও শুরু করে। রাজ্যে ক্ষমতাবদলের পরে এই ঘটনায় সুশান্ত ঘোষ, তপন ঘোষ, সুকুর আলি এরা গ্রেফতারও হন। যদিও যথাযথ প্রমাণের অভাবে ও সাক্ষীরা বিরূপ হওয়ায় তাঁরা বেকুসুর খালাস পেয়ে যান। তবে বক্তার ও তাঁর স্ত্রী আয়েষা মণ্ডল প্রথম থেকেই এই কথাই বলে এসেছেন। আর তাঁদের দুইজনের সাক্ষীই এই ঘটনার তদন্তের ক্ষেত্রে মূল অস্ত্র।
জানা গিয়েছে, রবিবার সকালে বাজার থেকে বাড়ি ফিরে অসুস্থ বোধ করেন বক্তার। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই মৃত্যু হয় তাঁর। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে এদিন তাঁর বাড়িতে যান তৃণমূল ব্লক সভাপতি সেবাব্রত ঘোষ। কার্যত যার বাড়ির ঘটনা আর সাক্ষ্যের জেরে গোটা ছোট আঙাড়িয়ার নাম দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল তার মনের জোর ও সাহসকে আগেই কুর্ণিশ জানিয়েছিল গ্রামবাসীরা। এদিন তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় গ্রাম জুড়েই শোকের পরিবেশ নেমে এসেছে। বক্তার চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। লালসন্ত্রাসের মুখে দাঁড়িয়েও সিপিএমের চোখে চোখ রেখে বার বার একই বক্তব্য জানিয়ে গিয়েছেন তিনি। তাঁর সাক্ষীতেই বঙ্গবাসী, ভারতবাসী, বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে সিপিএম বাংলায় কোন ধরনের সন্ত্রাস চালিয়ে ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতায় টিকে ছিল। আর ক্ষমতা ছাড়া হতেই বাংলা মানুষ তাঁদের বাংলার বিধানসভা থেকেই বিলুপ্ত করে দিয়েছে।