নিজস্ব প্রতিনিধি: পরিবর্তনের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়(Mamata Banerjee) রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সব থেকে বেশি জোর দিয়েছিলেন যে জায়গাটিতে তা হল প্রসূতি ও শিশুমৃত্যুর ঘটনা রোখা। কিন্তু সেই পরিবর্তনের ১১ বছরের মাথায় ২০২২ সালের এপ্রিল-ডিসেম্বর সেই সময়েও দেখা যাচ্ছে বাংলার বুকে প্রসূতি মৃত্যুর(Maternal Death) ঘটনা কিন্তু একদম বন্ধ হয়ে গিয়েছে এমন নয়। ২০২২ সালের এপ্রিল-ডিসেম্বর, এই ৯ মাসে বাংলার(Bengal) বুকে ৯৫৪ জন প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনা উঠে এসেছে। স্বাস্থ্যভবন সূত্রে তেমনটাই জানা গিয়েছে। আর এই ঘটনা ঘিরেই এখন উদ্বিগ্ন রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা। মুখ্যমন্ত্রী এর আগে একাধিক সরকারি অনুষ্ঠানে প্রসূতিদের রেফার আটকাতে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। স্পষ্ট করে বলেছেন, মায়েদের মৃত্যু যেকোনও উপায়ে রুখতে হবে। তারপরেও এই পরিসংখ্যান স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের ভাবাচ্ছে রীতিমত। আর এই মৃত্যুর পিছনে যে সব কারণ উঠে এসেছে তার মধ্যে অন্যতম হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে সিজার ও অ্যানিমিয়ার সহ একাধিক ঘটনা।
আরও পড়ুন মমতার সরকারকে ফেলে দেওয়ার চক্রান্ত, আক্রমণ উদয়নের
রাজ্যের স্বাস্থ্যদফতরের আধিকারিকদের দাবি, রাজ্যে এই প্রসূতিদের মৃত্যুর পিছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করছে। ছোট-মাঝারি নার্সিংহোমের গাফিলতির জন্য যেমন মায়েদের মৃত্যু বাড়ছে তেমনি অত্যাদিক সিজার হওয়ার ফলেও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এর পাশাপাশি অন্যতম কারণ হিসাবে উঠে এসেছে প্রসূতিদের অ্যানিমিয়ার ঘটনা ও সেপটিসিমিয়া বা রক্তের প্রাণঘাতী সংক্রমণ। স্বাস্থ্যকর্তাদের চিন্তার আরও দু’টি বড় কারণ প্রসূতিদের মধ্যে ডায়াবেটিস এবং প্রেগন্যান্সি ইনডিউজড হাইপ্রেশার বেড়ে যাওয়ার ঘটনা। যেকোনও রাজ্য বা দেশে মাতৃমৃত্যুর কম হারকে স্বাস্থ্য ও সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের অন্যতম সূচক ধরা হয়। বাম জমানার তুলনায় গত ১১ বছরে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। সার্বিক উন্নতি হয়েছে বেশিরভাগ সূচকের। কিন্তু, এরই মধ্যে স্বাস্থ্য দফতরের উদ্বেগ হয়ে থাকছে এই প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনা। বাম জমানায় রাজ্যে বাল্য বিবাহ ঠেকাতে কার্যত সেভাবে কোনও উদ্যোগই নেওয়া হতো না। আর তার জেরে কিশোরী অবস্থাতেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো বা তাঁরা প্রেম করে বাড়ি থেকে পালিয়ে নিজেরাই বিয়ে করে নিত। আর তার জেরে অপক্ক শরীরের গর্ভবতী হয়ে পড়ায় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যেত অনেকেই।
আরও পড়ুন মমতার বাংলার ‘লাখপতি দিদি’রা টেক্কা দিল ‘ডবল ইঞ্জিন’দের
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে ‘কন্যাশ্রী’(Kanyasree) ও ‘রূপশ্রী’(Rupasree) প্রকল্প দুটি মেয়েদের সেই বাল্য বিবাহ ঠেকাতে অনেকটাই কাজে দিয়েছে। কিন্তু কোভিডকালে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক মেয়েকেই বাড়ির লোকেরা বিয়ে দিয়ে দেন যা স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানতেও পারেননি। দেখা যাচ্ছে সেই সব মেয়েই অপরিণত শরীরে মা হতে গিয়ে নানা সমস্যার মুখে পড়ে মারা যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর কড়া নির্দেশের কারণে রাজ্যে এখন রেফারের সংখ্যা খুব কমই ঘটে। তাই প্রসূতিদের ক্ষেত্রেই রেফারজনিত মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটাই কমে গিয়েছে। কিন্তু চিন্তা বাড়িয়েছে শহরে বা মফঃস্বলে কিংবা গ্রামে গজিয়ে ওঠা বেসরকারি সব নার্সিংহোম বা হাসপাতাল। সেখানে প্রসব-পরবর্তী জটিলতা হলেই তাঁরা ঝামেলা এড়াতে আশঙ্কাজনক রোগীদের সরকারি হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজে রেফার করে দিচ্ছে। একেবারে মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁরা আসছেন। এদের জীবন বাঁচাতে গিয়েই কার্যত কালঘাম ছুটে যাচ্ছে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের। বেশির ভাগকে বাঁচানো গেলেও সব মৃত্যু ঠেকাতে তাঁরাও পাচ্ছেন না। গত ন’মাসে বাংলায় আনুমানিক ১০ লক্ষ প্রসব হয়েছে। তার মধ্যে মৃত্যুর ঘটনা ৯৫৪। অর্থাৎ প্রতি এক লক্ষ প্রসবে একশোর বেশি মায়ের মৃত্যু হয়েছে। সংখ্যা হিসেবে এটা মোটেই উপেক্ষা করার মতো নয়।
আরও পড়ুন পরকীয়া হোক বা যে কোন ঘটনা জানাতে হবে পুলিশকে : ফিরহাদ
স্বাস্থ্য কর্তাদের দাবি, ৯৫৪টি মৃত্যুর মধ্যে অন্তত ৪৮ শতাংশ ক্ষেত্রে মায়েদের সিজার হয়েছিল। সিজার পরবর্তী জটিলতা মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসাবে উঠে এসেছে। সার্বিকভাবে মাত্র ১৪-১৫ শতাংশ প্রসব সিজারের মাধ্যমে হওয়া উচিত, সেটা এখানে হচ্ছে প্রায় ৩৮ শতাংশ! আবার এটাও দেখা যাচ্ছে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠার পড়েও মেয়েদের মধ্যে খামতি থেকে যাচ্ছে। তার জেরেও মায়েদের ক্ষেত্রে মৃত্যু হতে দেখা যাচ্ছে। তাঁদের ফুসফুস ও হার্টের দুর্বলতা চোখে পড়ছে। বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসাজনিত জটিলতাও বহু ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হিসাবে উঠে আসছে। বহু ক্ষেত্রে প্রাইভেটে এসব চিকিৎসা হচ্ছে। কিন্তু কেস অত্যন্ত জটিল হলেই রেফার করা হচ্ছে সরকারি জায়গায়। তখন অবস্থা এতটাই খারাপ থাকছে, কিছুই করবার থাকছে না। অ্যানিমিয়া নিয়েও প্রসব করাতে আসছেন গ্রামগঞ্জের বহু মা। এঁদের বাঁচানো কার্যত অসম্ভব। পুষ্টিকর খাদ্য, সময়মতো চেক আপ, কম সন্তান—এই তিনটি প্রধান বিষয়ের ওপর জোর দিতেই হবে এই মৃত্যু ঠেকাতে হলে।