কৌশিক দে সরকার: কয়েক দশক ধরেই ঘটি-বাঙালের তরজা বাঙালি দেখে এসেছে। দেখেছে রুদ্ধশ্বাস মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলের ফুটবল ম্যাচও। দেখেছে ইলিশ-চিংড়ির লড়াইও। তবুও তার মধ্যেও ছিল ঘটি পোলার সঙ্গে বাঙাল পুলির প্রেম। ছিল তাঁদের ঘরসংসার। এপার বাংলার বাঙাল ভোট দীর্ঘদিন ধরেই ছিল বামেদের দখলে। পরে তার কিছুটা এসেছে তৃণমূলের দিকে। যদিও বেশির ভাগটাই থেকে গিয়েছিল বামেদের সঙ্গেই। কিন্তু বাংলার(Bengal) মাটিতে বিজেপির উত্থানের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছিল, বামেদের হাতে থাকা বাঙাল ভোটের একটা বড় অংশই চলে গিয়েছিল পদ্ম শিবিরে। কিন্তু সেই বাঙাল ভোটকে(East Bengal Peoples Vote Bank) নিয়ে এখন নতুন করে আশঙ্কা শুরু হয়েছে বঙ্গ বিজেপির(BJP) অন্দরে। অনেকেই মনে করছেন, Citizenship Amendment Act, 2019 বা CAA লাগু হওয়ার জেরে সেই বাঙাল ভোটের বড় অংশই হারাতে চলেছে বিজেপি। সেই ভোট কিছুটা ফিরতে চলেছে বামেদের ঝুলিতে, আর বেশির ভাগটাই যাচ্ছে তৃণমূলের(TMC) ঘরে। নেপথ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের(Mamata Banerjee) পাট্টা প্রদানের নীতি।
ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় চলে আসা মতুয়ারা দীর্ঘদিন ধরে নাগরিকত্বের দাবি জানিয়ে আসছেন। সেই নাগরিকত্ব প্রদানের টোপ দেখিয়ে উনিশের লোকসভা নির্বাচন এবং একুশের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁদের ভোট আদায় করেছিল বিজেপি। এবারে ভোটের মুখে লাগু করেছে Citizenship Amendment Act, 2019 বা CAA। কিন্তু সেই আইনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পেতে গেলে এমন ভাবে আবেদন জানাতে হবে যে সবার আগে এতদিন ধরে এই দেশে বসবাস করা মানুষেরা এক নিমেষেই তাঁদের ভোটাধিকার, রেশনের অধিকার, যাবতীয় সরকারি প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার হারিয়ে ফেলবেন। আর তাই কোন মতুয়া এগিয়ে এসে এই আইনের মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাতে চাইছে না। যা কার্যত বলে দিচ্ছে, বিজেপি ২৪’র ভোটে(Loksabha Election 2024) যে মতুয়া ভোট ব্যাঙ্ক নিজেদের দখলে রাখতে এই CAA আইন লাগু করেছিল, সেই উদ্দেশ্যটাই মাঠেমারা পড়েছে। মতুয়ারা রীতিমত মুখ ঘোরাতে শুরু করে দিয়েছেন বিজেপির দিক থেকে। আর এই অবস্থায় পদ্ম শিবিরের আশঙ্কা মতুয়া মতুয়া করতে গিয়ে হাতে আসা বাঙাল ভোটও এবার না বেড়িয়ে যায়!
কেন বাঙালদের আশঙ্কা কোথায়? ওপার বাংলা থেকে আসা এপার বাংলায় বসবাস করা মানুষদেরই আমরা বাঙাল বলে চিনে থাকি। কিন্তু মনে রাখা উচিত, এরা কেউই মতুয়া নন। এদের কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ কায়স্থ, কেউ বেনে, কেউ তেলি। এপার বাংলায় এখন সেই বাঙাল মানুষদের সংখ্যা খুব কম করেও ২ কোটির আশেপাশে। দীর্ধ লড়াই করে এরা আজ অনেকেই এপার বাংলায় বা ভারতে কিংবা বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। মান-সম্মান অর্জন করেছেন। কলকাতা সহ দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব বর্ধমান, দুই মেদিনীপুর এবং বিশেষ ভাবে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে হাজারও কলোনিতে আজও এদের বসবাস। এরা যে সবাই এক সঙ্গে এপার বাংলায় চলে এসেছে তা কিন্তু নয়। কেউ এসেছেন স্বাধীনতার আগে, কেউ দেশ ভাগের সময়ে। কেউ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, আবার কেউ তারও পরে। এদের অনেকেরই সেই সব নথিপত্র নেই যা দেখিয়ে তাঁরা নাগরিকত্বের আবেদন জানাতা পারবেন। এদের ভয়, ২৪’র ভোটে জিতে কেন্দ্রে আরও একবার বিজেপি সরকার গড়তে পারলেই NRC লাগু করে দেওয়া হবে। তখন তাঁদের কী হবে?
এই ভয় থেকেই ২৪’র ভোটে এই বাংলার বুকে বাঙাল ভোটের একটা বড় অংশই বিজেপির হাতছাড়া হতে চলেছে। আর সেই ভোটের বড় অংশই ঢুকতে চলেছে তৃণমূলের পকেটে। নেপথ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাট্টা প্রদানের নীতি। গত কয়েক বছর ধরেই মমতা জোর দিয়েছেন রাজ্যের বিভিন উদ্বাস্তু কলোনি ও বাঙাল কলোনির বাসিন্দাদের হাতে তাঁদের বসত জমির পাট্টা তুলে দেওয়ার কাজের ওপর। নিয়ম করে প্রতিটি সরকারি অনুষ্ঠানে সেই বসত জমির পাট্টা মমতা নিজে বা প্রশাসনের আধিকারিকদের মাধ্যমে তুলে দিয়েছেন সেই সব কলোনির বাসিন্দাদের হাতে। আগামী দিনে যদি কেন্দ্র সরকার NRC লাগুও করে তবুও ওই সব জমির বাসিন্দাদের আর তুলতে পারবে না বিজেপির সরকার। ওই সব জমিতে বসবাসকারীদের আর বলতে পারবে না তাঁরা এদেশের নাগরিক নন। পাঠাতে পারবে না তাঁদের কোনও ডিটেনশান ক্যাম্পে। কেননা বসত জমির পাট্টা হাতে থাকা মানে সে এবং তাঁর পরিবার এই দেশেরই নাগরিক। আর তাই বিজেপিতে নয়, বাঙালদের আস্থা এবার মমতায়। তৃণমূলে।