নিজস্ব প্রতিনিধি: একটা বাঁক, কার্যত সেটাই কিন্তু একটি ঘূর্ণিঝড়কে ঠেলে দিল অপমৃত্যুর দিকে। সেই সঙ্গে স্বস্তির বার্তা এনে দিল তার সম্ভাব্য অভিমুখে থাকা ৩টি রাজ্যের কয়েক লক্ষ মানুষকে। নজরে জাওয়াদ। বঙ্গোপসাগরে জন্ম নেওয়া এই ঘূর্ণিঝড় সাম্প্রতিক কালে বিরল এক অভিজ্ঞতার সাক্ষী করে দিয়ে গেল আবহাওয়াবিদদের পাশাপাশি আমজনতাকেও। শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আবহাওয়াবিদরা কার্যত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন এই ঘূর্ণিঝড়কে ঘিরে। একপক্ষের অভিমত ছিল শনি ভোরেই তা আছড়ে পড়বে অন্ধ্রপ্রদেশ ও ওড়িশা সীমান্তবর্তী উপকূলে। অপর পক্ষের অভিমত ছিল তা রি-কার্ভ নিয়ে ওড়িশার দিকে এগিয়ে আসবে। তবে তা স্থলভূমিতে না ঢুকে উপকূল ধরে এগোবে বাংলার দিকে। শনিবার ভোরে দেখা গেল এই দ্বিতীয় মতটিই বাস্তব আকার নিতে চলেছে। জাওয়াদ রি-কার্ভ নিয়ে ওড়িশার দিকে এগোতে শুরু করে দিয়েছে। তবে স্বস্তির বার্তা এটাই, হয় সে পুরীতে ভূমিস্পর্শ করবে নাহলে তা শক্তিক্ষয় করতে করতে বাংলার দিকে এগোবে।
দিল্লির মৌসম ভবনের দেওয়া তথ্য বলছে শনিবার ভোর ৫টা নাগাদ জাওয়াদের অবস্থান ছিল বিশাখাপত্তনম থেকে ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে, পুরী থেকে ৪৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে। সবথেকে বড় ঘটনা সাগরে এখন খুবই ধীর গতিতে এগোচ্ছে জাওয়াদ। অথচ শুক্রবার বিকালেই সে ঘন্টায় ৩২ কিমি বেগে স্থলভূমির দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে দিয়েছিল। তার জেরেই মনে করা হচ্ছিল শনি ভোরেই সে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলাম জেলার কলিঙ্গপত্তনম ও ওড়িশার গঞ্জাম জেলার গোপালপুরের মধ্যবর্তী এলাকায় আছড়ে পড়তে চলেছে। কিন্তু বিকালেই সেই মতকে খন্ডন করে আবহাওয়াবিদরা দাবি করেন স্থলভূমিতে শনি ভোরে পা রাখবে না জাওয়াদ। বরঞ্চ তা সাগরের বুকেই রি-কার্ভ নেবে। অর্থাৎ প্রায় ১৮০ ডিগ্রি এক বাঁক নেবে। তবে সেই বাঁক সে নেবে ৩ ধাপে। প্রথম ধাপে সে বাঁক নেবে ওড়িশার দিকে। দ্বিতীয় ধাপে সে বাঁক নেবে পুরীর কাছে এসে এবং তৃতীয় ধাপ সে নেবে বাংলার কাছে এসে। শনি ভোরে কিন্তু সেটাই হতে দেখা যাচ্ছে। শুক্রবার মধ্যরাতের পর থেকেই গতি কমতে শুরু করে দিয়েছে জাওয়াদের। ভোরে তার গতিবেগ দাঁড়িয়েছে ঘন্টায় মাত্র ৬কিমি। তবে সাগরের বুকে থাকাকালীন অবস্থায় শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে সে।
দিল্লির মৌসম ভবন শনিবার সকালে সুস্পষ্ট করে দিয়েছে জাওয়াদ ঘূর্ণিঝড় হিসাবে স্থলভূমিতে প্রবেশ সম্ভবত করবে না। ইতিমধ্যেই সেই বাঁক নিয়ে ওড়িশা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। তার জেরে গতকাল রাত থেকেই ওড়িশার উপকূলবর্তী এলাকায় ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। রবিবার বিকালের মধ্যেই জাওয়াদ পুরীর কাছাকাছি চলে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থাৎ শনিবার সকাল থেকে রবিবার বিকাল পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টিতে ভাসতে চলেছে ওড়িশা। বাংলাতেও শুরু হয়ে গিয়েছে বৃষ্টি। পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় এদিন সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে বেলা যত এগোবে গড়াবে এই বৃষ্টির জোর তত বাড়বে। সঙ্গে দেবে ঝোড়ো হাওয়া। ইতিমধ্যেই দুই উপকূলবর্তী জেলা ছুঁয়ে থাকা সাগরে বড় বড় ঢেউ উঠতে দেখা যাচ্ছে। হাওড়া, কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা, হুগলি, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলায় এদিন সকাল থেকেই টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে দিয়েছে। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের দাবি এদিন দুই মেদিনীপুরে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হবে। উত্তর ২৪ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি ও ঝাড়গ্রামে এদিন ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
আয়লা থেকে আম্ফান, গত এক দশকে বাংলা তথা পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব উপকূলে সাড়া জাগানো ঘূর্ণিঝড়গুলিকে দেখা গিয়েছে তাঁরা সাগরের বুকে বাঁক নিয়ে বা স্থলভূমিতে ঢুকে বাঁক নিয়েছে। সেখানেই ব্যতিক্রমী হয়ে থেকে গেল জাওয়াদ। অতি বিরল হিসাবে সে রি-কার্ভ নিচ্ছে আর সেটাও সাগরের বুকে। আর সেই রি-কার্ভের জেরেই তার গতি গিয়েছে কমে। আবহাওয়াবিদদের দাবি, এদিন সারাদিন পুরীর দিকেই ধীর কদমে এগোবে সে। সেই সঙ্গে ঘটবে তার শক্তিবৃদ্ধিও। কিন্তু আগামিকাল দুপুরের মধ্যে সে পুরীর কাছে পৌঁছে গিয়েও সম্ভবত সে স্থলভাগে ঢুকবে না। বরঞ্চ সেখানে সে আবারও বাঁক নেবে বাংলার দিকে। সোমবার সকালে সে সুন্দরবন লাগোয়া উপকূলে হাজির হবে। কিন্তু সেখানেও নেবে সে বাঁক স্থলভূমিতে না ঢুকে তা সুন্দরবন ছুঁয়ে চলে যাবে সে বাংলাদেশের দিকে। একই সঙ্গে আবহাওয়াবিদদের দাবি, রি-কার্ভ আর দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার জেরে পুরী ছোঁয়ার আগে থেকেই সাগরের বুকেই শুরু হয়ে যাবে জাওয়াদের শক্তিক্ষয়। সুন্দরবন এলাকায় যখন সে হাজির হবে তখন আর সে ঘূর্ণিঝড় থাকবে না। বরঞ্চ গভীর নিম্নচাপ হিসাবেই সে সুন্দরবনকে ছুঁয়ে যাবে। তার জেরে ঝড়ের মুখে না পড়লেও দুই ২৪ পরগনা, দুই মেদিনীপুর, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি ও ঝাড়গ্রাম জেলা ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির মুখে পড়বে। দক্ষিণবঙ্গের বাকি জেলাগুলিতে মাঝাই মাপের বৃষ্টি হবে। মালদায় হবে হালকা বৃষ্টি। একই সঙ্গে শনিবার রাত থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় তীব্র জলোচ্ছ্বাসের ঘটনা শুরু হয়ে যেতে পারে।