নিজস্ব প্রতিনিধি: শক্তির আরাধ্যভূমি বীরভূম(Birbhum)। সিদ্ধভূমিও বটে। এই বীরভূমের বুকেই এমন এক কালী মা রয়েছেন যিনি বাগদি-বাউড়ি-শাঁখারিদের(Bagdi-Bauri-Shankhari) পুজো ছাড়া যেমন সন্তুষ্ট হন না, তেমনি দেবী লোবা না-ডাকলে, ভক্তরা তাঁর মন্দিরে পৌঁছাতেও পারেন না। বীরভূম জেলার সদর শহর সিউড়ি(Suri)। সেই শহর থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে এবং জেলার অপর এক পুরসভা দুবরাজপুর(Dubrajpur) থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে লোবা(Loba) গ্রাম। সেখানেই পুজিত হন জাগ্রতা লোবা-মা(Loba Kali Maa)। বীরভূম জেলার যে সমস্ত স্থান কালীপুজোর জন্য বিখ্যাত, তার মধ্যে এই লোবা কালিমন্দির অন্যতম। কয়েকশো বছরের প্রাচীন এই কালীপুজো। কথিত আছে, বহু মানুষ এই লোবা দেবীর মন্দিরে এসে তাঁদের উত্তরণের পথ খুঁজে পেয়েছেন। পূরণ করেছেন মনস্কামনা। উদ্ধার পেয়েছেন বহু আপদ-বিপদ থেকেও।
জানা যায়, কয়েকশো বছর আগে সিদ্ধপুরুষ রামেশ্বর দণ্ডী এই পুজো চালু করেছিলেন। তিনি নিজেই মূর্তি তৈরি করতেন। নিজেই পুজো করতেন। আবার, পুজোর পর মূর্তির বিসর্জন দিতেন। তিনশো বছর আগে রামেশ্বর দণ্ডী ঘুরতে ঘুরতে চলে আসেন লোবায়। সেখানেই অজয় নদের তীরে প্রতিষ্ঠা করেন নিজের আরাধ্যা দেবীকে। তিনি কাশীবাসী হওয়ার আগে লোবা গ্রামের ঘোষ আর চক্রবর্তী পরিবারের হাতে পুজোর দায়িত্ব দিয়ে যান। সেই থেকেই এই গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন মা লোবা। কার্তিক মাসের কালীপুজোয় এখানে খুব বড় আকারে পুজো হয়। সেই সময় গোটা দেশ থেকে ভক্তরা এই মন্দিরে আসেন। এছাড়াও প্রতি অমাবস্যায় হাজার দুয়েক ভক্ত এই মন্দিরে আসেন। তাঁরা প্রসাদ গ্রহণ করেন। ভক্তদের বিশ্বাস, এই মন্দিরে দেবীর কাছে প্রার্থনা করলে দেবী চিন্তা মুক্ত করে দেন। এর ফলে মন্দিরে উপস্থিত ভক্তদের মনে একটা প্রশান্তি বিরাজ করে।
রামেশ্বর দণ্ডী পরিব্রাজক সাধু ছিলেন। তিনিই গ্রামের নিম্নবর্গের মানুষকে যুক্ত করেন এই পুজোর সঙ্গে। বংশ পরমম্পরায় তাই বাগদিরা দুর্গাপুজোর দশমীতে অজয় নদ পেরিয়ে মূর্তি তৈরির জন্য মাটি আনেন বর্ধমান জেলার র্গৌরবাজারের তালপুকুরের থেকে। তারাই মাথায় করে আনেন সেই মাটি। একাদশী তিথিতে ওই মাটি দিয়ে মূর্তি তৈরি করার কাজ শুরুর রীতি চলে আসছে। দেবী দুর্গার ঘট বিসর্জনের পর সারা বছর সেই পুকুরে পড়ে থাকা ‘লোবার মা’-এর কাঠামো জল থেকে তুলে মন্দিরে রাখা হয়। মূর্তি তৈরিতে খড়ের কাঠামো তৈরির জন্য যে বাবুই দড়ি লাগে, তা বংশপরম্পরায় জোগান দেয় বাউড়ি পরিবার। একই ভাবে মূর্তি তৈরির দায়িত্বে রয়েছেন সুত্রধররা। সন্ন্যাসী সূত্রধর ও তাঁর পরিবারের লোকজন বংশপরম্পরায় এই কাজ করে আসছেন। পুজোর দিন তৈরি শেষ হলে বেদিতে স্থাপন করে অলঙ্কার পরিয়ে ঘোষ পরিবার মূর্তি তুলে দেন ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের হাতে। পুজোয় প্রদীপ জ্বালানোর জন্য যে ঘি ব্যবহৃত হয়, তা বংশপরম্পরায় গোয়ালা পরিবার জোগান দেয়। নিশিরাতে পুজো শুরু হয়। সূর্যোদয় হতেই জেলেদের হাতে চলে যান দেবী। তাঁরাই করেন দেবীর বিসর্জন।
এই পুজো ঘিরে যেমন উন্মাদনা দেখা যায় তেমনি উন্মাদনা দেখা যায় যেমন বিসর্জনেও। কালীপুজোর(Kali Puja 2023) ঠিক পরের দিনই লোবার কালীভাসা পুকুরে বিসর্জন হয়। পুজোকে ঘিরে বসে একদিনের মেলা। হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন। তবে শুধু লোবার কালী নয় পাশের গ্রাম বাবুপুরের কালীও একসঙ্গে বিসর্জন হয়। বাবুপুরের কালী ও লোবার কালীকে অনেকে বলেন দুই বোন। দুই বোনের সঙ্গে বিসর্জন হয় গ্রামের আরও একটি কালী। যেটি এলাকায় খ্যাপা মা বলে পরিচিত। তিনিও নাকি ওই দুই দেবীএর এক বোন। তাই গ্রামের লোকেরা লোবার কালীকে বড়মা, বাবুপুরের কালীকে মেজো মা এবং বরারির কালীকে ছোটমা বলে ডাকেন। এই পুজো ঘিরে উৎসবে মেতে ওঠেন হিন্দু ও মুসলমানের সম্প্রদায়ের মানুষ। সপ্তাহব্যাপী চলে সম্প্রীতির উৎসব।