নিজস্ব প্রতিনিধি: হুগলি(Hooghly) জেলার শ্রীরামপুর(Sreerampur) মহকুমার চণ্ডীতলা(Chanditala)-২ ব্লকের একটি অন্যতম পরিচিত গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা হল জনাই(Janai)। আবার এই জনাই গ্রামখানি বিখ্যাত সেখানকার জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো এবং একটি বিশেষ মিষ্টির জন্য। সেই বিশেষ মিষ্টিটির নাম মনোহরা(Monohora)। এবার এই মনোহরাই দৌড় শুরু করেছে জিআই ট্যাগের(GI Tag) জন্য। রাজ্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের মাধ্যমে আবেদন জমা পড়েছে জিআই ট্যাগ বা জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশনের জন্য। কোনও একটি নির্দিষ্ট এলাকার কোনও পণ্য যদি প্রসিদ্ধি লাভ করে, তাহলে সেই এলাকার নামে পণ্যটির স্বত্বের অধিকার পাওয়া যায়। সেটাই জিআই। এখন এই তকমাপ্রাপ্তির দিকেই তাকিয়ে আছেন জনাইবাসী, যদি এই তকমার হাত ধরে গ্রামটি খাদ্যপ্রেমী ও মিষ্টিপ্রেমীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
মনোহরা হল ছানা ও চিনির অথবা সরচাঁছি ও ক্ষীরের মিশ্রণের গোল্লার ওপর চিনির স্তর দেওয়া একটি গোলকাকৃতি মিষ্টি। এই মিষ্টির ইতিহাস দু’শো বছরের ওপর। জনাইয়ের মনোহরার উৎপত্তি নিয়ে একাধিক মত প্রচলিত আছে। অতার মধ্যে সব থেকে অধিক যে গ্রহণযোগ্য তা হল, ব্রিটিশ আমলে জনৈক ব্রিটিশ ব্যক্তি কলকাতা থেকে জনাই বেড়াতে যান। তখনও ভীমচন্দ্র নাগেদের বংশের একটি শাখা জনাইয়ের ষষ্ঠীতলায় বসবাস করত। জনৈক ব্রিটিশ ব্যক্তি সেই ময়রাদের হুকুম করেন যে এমন এক মিষ্টি তৈরি করতে হবে যা ৫ দিন রেখে দেওয়া যাবে। সেই সময় ফ্রিজ ছিল না, কিন্তু জনাইয়ের তৎকালীন দুই বিখ্যাত মিষ্টি শুকনো বোঁদে এবং নিখুঁতি এমনভাবে তৈরি করা হত যাতে তা বেশ কিছু দিন রেখে দেওয়া যায়। ভীমচন্দ্র নাগেদের বংশের শাখাটি তখন বুদ্ধি খাটিয়ে মূল মিষ্টির ওপর পুরু চিনির আস্তরণ তৈরি করেন যাতে তার মধ্যে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ না হয়, এবং মিষ্টিটি অনায়াসে তিন থেকে পাঁচ দিন রেখে দেওয়া যায়। কার্যত সেই থেকেই মনোহরার যাত্রা শুরু বাংলার মিষ্টি মানচিত্রে।
জনাইয়ের মনোহরার মূল উপকরণ ছানা, চিনি, পেস্তা, এলাচ ও দুধ। এছাড়া ডাবের শাঁসও ব্যবহার করা হয়। ছানার সাথে মিহি করা চিনি ও ছোট এলাচ মিশিয়ে তা আগুনে জ্বাল দেওয়া হয়। লক্ষ্য রাখা হয় যাতে মিশ্রণটিতে দানা ভাবটি থাকে। মিশ্রণটা ক্রমশ গাঢ় হয়ে মাখা সন্দেশের মত হলে তা আগুন থেকে নামিয়ে রাখা হয়। মিশ্রণটি ঠান্ডা হলে তার থেকে মন্ড প্রস্তুত করা হয়। মন্ড থেকে কিছুটা করে মিশ্রণ হাতের তালুতে নিয়ে গোল্লা পাকানো হয়। তারপর গোল্লাগুলিতে পেস্তা ও এলাচের গুঁড়ো মাখানো হয়। অন্যদিকে ঘন চিনির রস জ্বাল দিয়ে একটি করে গোল্লা সেই রসে ডুবিয়েই তা তুলে রাখা হয় কলাপাতার ওপর। মিনিট চারেকের মধ্যে ঘন চিনির রসের প্রলেপটি শুকিয়ে একটি শক্ত আস্তরণে পরিণত হয়। জনাইয়ের মনোহরা একসময় কলকাতার রসগোল্লা, শক্তিগড়ের ল্যাংচা ও বর্ধমানের সীতাভোগের মত সমান জনপ্রিয় ছিল। মুখে মুখে এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায় এবং ক্রমে সারা ভারতে।
ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় এবং ব্রিটিশ অভিজাতরা অতিথি আপ্যায়নের জন্য জনাইয়ের মনোহরা আনাতেন। ক্রমে ব্রিটেনেও মনোহরার বাজার তৈরি হয়। পরবর্তীকালে মনোহরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানিতেও রফতানি হতে থাকে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মনোহরার খুব ভক্ত ছিলেন। ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার ও ছায়া দেবীর মত বাংলা চলচ্চিত্রের নায়ক নায়িকারা আউটডোর শুট করে কলকাতা ফেরার পথে প্রায়ই গাড়ি থামিয়ে মনোহরা কিনে বাড়ি ফিরতেন। সেই মনোহরা এবার নামছে জিআই ট্যাগের জন্য।
হুগলি জেলা মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সমিতির চেয়ারম্যান অমিতাভ দে এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘হুগলির মিষ্টির ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে ওঠা খুব কঠিন। আমাদের জেলা থেকে আরও মনোহরা ছাড়াও আরও বেশ কিছু মিষ্টির জিআইয়ের তকমা পাওয়ার জন্য তোড়জোড় চলছে জোরকদমে। এর মধ্যে সর্বাগ্রে আছে চন্দননগরের সূর্য মোদকের জলভরা, কামারপুকুরের সাদা বোঁদে ও মশাটের আঁইয়ার রাবড়িগ্রামের রাবড়ি। এছাড়াও লবঙ্গলতিকা বা গজার জন্মও কিন্তু হুগলিতেই। এমনকী কটেজচিজ বা ছানার উৎপত্তিও হুগলি জেলার ব্যান্ডেলে। সেই বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ জোগাড়ের কাজও শুরু করছি আমরা। সাত-আট প্রজন্ম ধরে যে মিষ্টি বাঙালির ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, সেই ইতিহাসের সেলিব্রেশনের প্রয়োজন আছে। হুগলি থেকে এতগুলো মিষ্টি যদি স্বীকৃতি পায়, আন্তর্জাতিক স্তরে সেই গরিমা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। আগামী প্রজন্মের কাছে তা আনন্দের বইকি!’