নিজস্ব প্রতিনিধি,বসিরহাট: মহা পুজোর অন্তিম লগ্নে দশমীতে দেবীর বিসর্জনের পর সকলেরই মন ব্যাথিত হয়ে ওঠে। চারিদিকে যেন চলতে থাকে বিষাদের সুর। আমরা কিছুতেই যেন ঊমাকে যেতে দিতে চাই না। কিন্তু রীতি মেনে তাকে তো বাপের বাড়ি ছেড়ে যেতেই হয়। আর তারপরেই আবার এক বছরের অপেক্ষা। কিন্তু চিত্রটা একটু অন্যরকম টাকির পুবের বাড়ির ক্ষেত্রে। কারণ সেখানে বিসর্জন এর পরেই একাদশী থেকে শুরু হয়ে যায় অভিনব এক ভোগের আয়োজন। বাপের বাড়ি থেকে দেবী যখন কৈলাসে মহাদেবের কাছে ফিরেছিলেন, তখন মহাদেব তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন বাপের বাড়ি থেকে কি খেয়ে এসেছো? উমা তখন জবাবে বলেছিলেন, “পান্তা আর কচু শাক”। সেই রীতি মেনেই টাকীর পুবের বাড়িতে(Taki Puber Bari) ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে বিসর্জনের পর পান্তা ভাত ও কচু শাকের ভোগের আয়োজন।
বসিরহাটের সীমান্ত শহর টাকির অতি প্রাচীন এই পুবের বাড়ির পুজো। আজ থেকে প্রায় ৩০১ বছর আগে টাকির তৎকালীন জমিদার জগবন্ধু রায় চৌধুরী এই পুজোর সূচনা করেন। তারপর ইচ্ছামতি দিয়ে অনেক জল বয়ে গেলেও পাল্টায় নি কোন রীতিনীতি। ষষ্ঠীর দিন নিয়ম মেনে বোধনের মধ্য দিয়ে মায়ের আগমন ঘটে এই পুবের বাড়িতে। তারপর টানা চলে পূজার উৎসব। রায়চৌধুরীদের এই পুবের বাড়িতে অষ্টমীর দিন পোলাও ও আলুর দমের ভোগ খেতে রাজ্য ও দেশ ছাড়িয়ে ভিনদেশের পর্যটকরা এখানে ভিড় জমান। প্রায় ১২ থেকে ১৫ হাজার মানুষের ভোগের ব্যবস্থা করা হয় ঐদিন। একসময় চালু ছিল বলি প্রথা। ১০১টি মহিষ ও ছাগ এমনকি ভেঁড়াও বলি দেওয়া হতো এই পুজোয়। আগে সেই সমস্ত মহিষ তথা ছাগল আনা হতো ওপার বাংলার সাতক্ষীরা, খুলনা ও দেবহাটা থেকে। কিন্তু দেশভাগের পর কলকাতা থেকে নিয়ে আসা হতো মহিষ ও ছাগল। কালের নিয়মে ক্রুড়তাকে পরিত্যাগ করে এখন সে বলি আর হয় না। বর্তমানে চালকুমড়ো ও আখের বলি দেওয়া হয় সেই ৩০০ বছর পুরনো হাড়িকাঠেই। কথিত আছে, বলি দেওয়া মহিষগুলিকে পার্শ্ববর্তী হাসনাবাদের মাখালগাছা গ্রামের মুচিরা নিয়ে যেতেন। এবং তার থেকে জুতো তৈরি করে তারা অর্থ উপার্জন করতেন। যদিও সেসব এখন অতীত। যদিও দশমীতে শুরু হয় অন্য এক উৎসব। বংশ-পরম্পরায় ২৬ বেহারার কাঁধে করে মা যান ইছামতির রাজবাড়ি ঘাটে। যা রায়চৌধুরী পরিবারের নিজস্ব ঘাট। সেখান থেকেই বিসর্জনের পর্ব শুরু হয় এই পুবের বাড়ির উমার।
রীতি রয়েছে যতক্ষণ না পর্যন্ত পূবের বাড়ির দেবীর বিসর্জন হবে ততক্ষণ টাকি-হাসনাবাদে কোন পুজোর বিসর্জন হয় না। আর বিসর্জনের পালা মিটলেই শুরু হয় এক অন্য ভোগের পালা। যে ভোগ পেতে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন। সেই পান্তা ভাত ও কচু শাকের অভিনব ভোগ। বছরভর কলকাতা সহ রাজ্য তথা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকলেও মহাপুজোর সময় রায়চৌধুরী(Samar Roy Chowdhury) বাড়ির সদস্যরা সকলেই এই পূজায় অংশগ্রহণ করেন। নিজের হাতেই তারা ভোগ রান্না করে আগত পুণ্যার্থীদের বিতরণ করেন। সেই প্রথা আজও অমলীন। পাশাপাশি এই পুবের বাড়ি থেকে দেবী যেন গিয়েও যান না। কারণ এই বাড়িতে অধিষ্ঠান রয়েছে দেবী দুর্গার। প্রায় ৩০০ বছরের নিয়ম রীতি মেনে সারা বছর নিত্য পূজার মধ্য দিয়ে তার পুজো করা হয়। প্রতিবারের মতো এবারও হাজার হাজার দর্শকের সমাগম হবে টাকির পুবের বাড়িতে। আর তার জন্যই মুখিয়ে রয়েছেন পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে টাকির বাসিন্দারা।