নিজস্ব প্রতিনিধি: ‘মায়ের পায়ের জবা হয়ে’ থেকে যেতে চেয়েছিলেন রাজা হতে না চাওয়া পান্নালাল ভট্টাচার্য। কিন্তু মাত্র ৩৬ বছর বয়সেই কী কারণে আত্মহত্যা করেছিলেন ‘ঘোরতর সংসারী’ পান্নালাল ভট্টাচার্য, আজও তা রহস্যে ঘেরা। যেমন তাঁর জীবন, তেমনই তাঁর শ্যামাসঙ্গীত, দুইই আজও জীবন্ত। হ্যাঁ মৃত্যুর ৫৫ বছর পরও কালীপুজোর মণ্ডপে মণ্ডপে বাজে তাঁর গাওয়া গাান, ‘আমার সাধ না মিটিল ’ বা ‘চাই না মাগো রাজা হতে’। ভক্তিমূলক সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এমন একচ্ছত্র আধিপত্য সত্যিই বিরল এবং অকল্পনীয়।
গ্রামোফোন রেকর্ড, এইচএমভি সংস্থা বা রেডিও কী বস্তু? হয়তো এই প্রজন্মের হাতেগোণা কয়েকজন সে সম্পর্কে জানেন। তবুও আশ্চর্যের বিষয় আজও কালীপুজো এলে বা কোথাও কালীপুজো হলে সাউন্ডবক্সে শোনা যায় পান্নালালের গান। যেন কালীপুজো এলেই ভীষণভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় শ্যামাসঙ্গীত শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য। যুগের পর যুগ কেটেছে। পান্নালাল যেন বহুমূল্য রত্ন পান্নার মতোই উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন। যিনি ৫৫ বছর আগেই অতীত হয়ে গিয়েছেন, কিন্তু এই শিল্পীকে যেন সযত্নেই এড়িয়ে চলেন স্বয়ং মহাকাল। তাই কালের সীমারেখা পেড়িয়ে আজও তিনি জীবন্ত।
পান্নালালের পরিবার বংশপরম্পরায় শাক্ত। প্রথম থেকেই শরীরে ভক্তিরসের ধারা বয়েছে পান্নালালের। তবুও তাঁর পান্নালাল হয়ে ওঠার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল স্বর্ণযুগের স্বনামধন্য শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের। যিনি সম্পর্কে পান্নালালে দাদা। আধুনিক বাংলা সিনেমার প্লে-ব্যাক শিল্পী হওয়ার বাসনা নিয়ে টলিউডে পাড়ি দেওয়া পান্নালালকে নিয়ে গিয়েছিলেন এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানিতে। বলেছিলেন, আজ থেকে এখানে ভক্তিগীতির দায়িত্ব দিন পান্নাকে। ও কোম্পানির মুখ রাখবে। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ছিলেন জহুরি, তাই রত্ন চিনতে তাঁর ভুল হয়নি সেটা আজও প্রমান হয় প্রতি কালীপুজোয়। একসময় বড় দাদা ধনঞ্জয় বলতেন, ‘অসংখ্য শ্যামাসঙ্গীত গাওয়ার পরেও পান্নার মতো আমি ওরকম নাড়ি ছেঁড়া মা ডাক ডাকতে পারলাম কই?’
জীবদ্দশায় ৩৬টি আধুনিক গান সমেত ১৮টি রেকর্ড, ৩টি বাংলা ছায়াছবির গান, এবং ৪০টি শ্যামাসঙ্গীতের রেকর্ড ছিল পান্নালালের। এমনকি শ্রী অভয় ছদ্মনামে বহু শ্যামাসঙ্গীতের গীতিকার ও সুরকার ছিলেন তিনি। ‘আমার সাধ না মিটিল’, ‘মা তোর কত রঙ্গ দেখব বল’, ‘মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানি না মা’ এই গানগুলিতে আসলে তিনি মা কালীকেই খুঁজতেন। তাই তাঁর গানে এত দরদ ছিল। আক্ষরিক জীবনেই তিনি মা কালীর দর্শন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। একসময় ঘোর সংসারী পান্নালাল ধীরে ধীরে সংসারের বন্ধন ছিঁড়েছেন। প্রায়ই গিয়ে শ্মশানে বসে থাকতেন। আর শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে মাকে ডাকতেন। সেটা ১৯৬৬ সাল। ওই বছরেই দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের সুরে পান্নালাল রেকর্ড করলেন ‘অপার সংসার নাহি পারাপার’। ওই বছরই মাত্র ৩৬ বছর বয়সে অবসাদ ও অতৃপ্তি নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। তবুও তিনি অমর হয়ে রয়েছেন তাঁর অসামান্য শ্যামাসঙ্গীতের দৌলতে।