নিজস্ব প্রতিনিধি: রামদুলাল দেব(Ramdulal Deb) ছিলেন কলকাতা(Kolkata) তথা বাংলার প্রথম কোটিপতি মানুষ। বাংলার ক্ষমতা যখন আস্তে আস্তে ব্রিটিশদের হাতে চলে যাচ্ছে পলাশি যুদ্ধের পরে, ঠিক সেই সময় মার্কিনদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সূত্রে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল রামদুলালের। আমেরিকা স্বাধীনতা লাভের পরে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে মশলা ও মসলিন রফতানির ব্যবসা শুরু করেন রামদুলাল। বদলে আমেরিকা থেকে আসতো নানান পণ্য। সেই ব্যবসার সূত্রেই কোটিপতি হন রামদুলাল। ১৭৭০ সালে উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটে তাঁর নিজের বাড়ি ‘রামদুলাল নিবাস’-এ দুর্গাপুজোর(Durga Pujo) সূচনা করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পরে সেই পুজোর দায়ভার চাপে তাঁর দুই ছেলে আশুতোষ নাথ দেব বা ছাতুবাবু(Chatubabu), ও প্রমথনাথ দেব বা লাটুবাবুর(Latubabu) ওপর। কলকাতার বাবু কালচারের দুই দিকপাল ছিলেন এই দুই ভাই। বুলবুলির লড়াই ও নানান অদ্ভুত শখের জন্য কলকাতার বাবু সমাজে এঁরা বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। এঁদের সময়েই এই বাড়ির দুর্গাপুজো খ্যাতি লাভ করে। এঁদের নামে পুজোর নাম হয়ে যায় ছাতুবাবু-লাটুবাবুর পুজো।
ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ির পুজো এখনও বনেদিয়ানা আর আন্তরিকতার মেলবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। সমস্ত রীতিনীতি মেনে আজও স্বমহিমায় টিকে রয়েছে। এই বছর এই পুজো ২৫৩ বছরে পা রাখল। এখানে মা দুর্গাকে দশমহাবিদ্যা রূপে পুজো করা হয়। প্রতিপদ থেকে পুজো শুরু হয়, যা চলে ১০ দিন ধরে। ষষ্ঠী পর্যন্ত শালগ্রাম শিলার পুজো করা হয়। এখানে শাক্ত, বৈষ্ণব ও শৈব তিনটি মতের মিলনে দেবীর আরাধনা করা হয়ে থাকে। বৃহৎ নান্দীকেশ্বর পুরাণ মেনে পুজো হয়ে আসছে বরাবর। সাবেকি একচালার ঠাকুর হয়। তবে চিরাচরিত পারিবারিক মায়ের রূপটি এখানে একটু অন্যরকম। এখানে প্রতিমার ডানদিকে মহাদেব ও বামে শ্রী রামচন্দ্র বিরাজ করেন। দুর্গার দুই সখী জয়া ও বিজয়া থাকে দুইপাশে। ১০৮টি রুপোর প্রদীপ জ্বেলে সন্ধিপুজো হয়। অষ্টমীতে কুমারী পুজোর প্রচলন আছে ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়িতে। তবে এখানে বিজয়া দশমীতে সিঁদুর খেলা হয় না। বরঞ্চ সেই সিঁদুর খেলা হয় অষ্টমীতে।
শুধু তাই নয়, পুজোর ৪ দিন এই বাড়ির সদস্যরা শাড়ি ও ধুতি পড়েন পুজো দেওয়ার সময়। অন্য কোনও পোষাক ওই সময় গৃহীত হয় না। এখানে পশুবলি হয় না, পরিবর্তে চালকুমড়ো ও আখ বলি দেওয়া হয়। অষ্টমীতে এখানে মহাভোজের ব্যবস্থা করা হয়। আত্মীয় পরিজন মিলিয়ে প্রচুর মানুষ নিমন্ত্রিত হন। এইদিন লুচি তরকারি ছাড়াও লেডিকেনি ও দরবেশ ভোগ দেওয়া হয় মা দুর্গাকে। এছাড়া অন্যদিন পঞ্চদেবতা, নবগ্রহ, ৬৪ দেবদেবী ও মা দুর্গাকে নিয়ে মোট ৭৯টি নৈবেদ্য প্রস্তুত করা হয়। অন্নভোগও দেওয়া হয়ে থাকে। দশমীতে প্রথমে ঘট বিসর্জন দেওয়া হয়। তারপর মা দুর্গার পুজো করা হয় অপরাজিতা রূপে। আগে নীলকন্ঠ পাখি উড়িয়ে কৈলাশে মহাদেবকে খবর পাঠানোর রীতি থাকলেও বর্তমানে সাদা পায়রার গলায় নীল রঙ করে তাকে ওড়ানো হয়। প্রতিমা বিসর্জনের আগে কনকাঞ্জলি দেবার প্রথা রয়েছে ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ির পুজোয়।
যে কথাটা না বললেই নয়, মা দুর্গার বাহণ সিংহের মুখ এখানে ঘোড়ার মতো। পুজোর ৪ দিন মা এখানে বহুমূল্যের অলঙ্কারে সুসজ্জিতা হয়ে ওঠেন। এখানে লক্ষ্মী ও সরস্বতী দুইজন জয়া ও বিজয়া হিসাবে পুজিতা হন। তাই তাঁদের হাতে ঝাঁপি ও বীণা থাকে না। তাঁরা দুইজনই পদ্মাসনের থাকেন। পুজোর ৪ দিনই মায়ের ভোগ রান্না করা হয় নুন ছাড়া। সেই সময় মাকে লুচি ও ৩ রকমের ভাজা দেওয়া হয়। সঙ্গে থাকে চাল, ফল, দই ও মিষ্টি সহযোগে নৈবেদ্য।