নিজস্ব প্রতিনিধি: আমরা যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেই, কোনো কাজ করি, কোনো মতামত দেই, বেশির ভাগ সময়ই আমরা নিজের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পুরো ঘটনা বা পারিপার্শ্বিকতা বিচার করি। পরস্পরের সাথে যোগাযোগের সময়ও বা কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আমরা বেশিরভাগ সময়েই শুধু নিজের দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করেই বিচার করি। সে ক্ষেত্রে অনেক সময় এর প্রভাব আমাদের আবেগ বা মনের ওপর পড়ে এবং আমরা মনে করি যে, ‘আমার সাথেই এটা কেন হলো’ বা ‘আমি কতটা খারাপ আছি’। শুধুমাত্র নিজের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখ্যা করার ফলে পুরো ব্যাপারটা একপেশে হয়ে দাঁড়ায়। নিজের ভালো থাকার জন্যই, কেবলমাত্র নিজের নয়, অন্যের দৃষ্টি ভঙ্গি দিয়েও পারিপার্শ্বিকতার ব্যাখ্যা করা দরকার।
কি করবেন
১) শাশুড়ি ও বৌমার সম্পর্কের ক্ষেত্রকে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যাক। এক্ষেত্রে শাশুড়িমা মনে করতে পারেন যে, ‘বৌমা আমার সংসারে এসে সবটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে। সে আমার নিয়মকানুন, এই সংসারের এতদিনের প্রচলিত রীতি নীতি বদলে ফেলতে পারে। আমার অধিকার, আমার কর্তৃত্ব, আমার ইচ্ছে, আমার সাজানো সংসার সবকিছু আমার হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই আমি কখনোই বৌমাকে মাথা তুলতে দেব না, বা নিজের স্বাধীনতা কায়েম করতে দেব না।’ এটি ওনার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পারিপার্শ্বিকতা ব্যাখ্যা করা। উনি যদি বৌমার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েও ভাবেন, যেমন উনি যদি ভাবেন, ‘একটি মেয়ে তার নিজের ঘর বাড়ি ফেলে, বাবা-মাকে ছেড়ে, একটি সম্পূর্ণ অন্য সংসারে এসেছে, তার নিজের মতনই। তারও অনেক স্বপ্ন আছে, ইচ্ছা আছে। তাকে প্রথমে আমার জায়গা করে দেয়া উচিত। সে যদি এই সংসারে ভালোবাসা পায়, তাহলে সেও ভালোবাসতে শিখবে। হাতটা বড় হিসেবে আমারই বাড়ানো উচিত।’
অপরপক্ষে বৌমা যে নতুন সংসারে এসেছে সে ও নিজের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভাবছে, ‘এই সংসারের নিয়ম কানুন, রীতিনীতি সম্পূর্ণটা আমার বাপের বাড়ি থেকে আলাদা। এভাবে আমি থাকতে অভ্যস্ত নই। আমাকে সবটাই পরিবর্তন করতে হবে নিজের সুবিধামতন। না করতে পারলে আমি থাকতে পারবো না। আমি আমার মতন সংসার করবো। আমার সমস্ত ইচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পূর্ণ করব। আমি কারোর অধীন নই।’ এক্ষেত্রে বৌমা শাশুড়ি মায়ের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভাবতে পারেন এইভাবে যে, ‘এই মানুষটি দীর্ঘ দিন ধরে তিলে তিলে একটি সংসার তৈরি করেছেন। কার কি পছন্দ, কিভাবে সুষ্ঠুভাবে সংসার চালানো যায় ইত্যাদি আমার থেকে অনেক ভাল জানেন। অনেক কষ্ট করে তিনি আজকে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে। সুতরাং তাকে শ্রদ্ধা,সম্মান করা আমার কর্তব্য। রাতারাতি আমি এইসব কিছুকে পরিবর্তন করতে পারবো না বা চেষ্টা করব না। বরঞ্চ আমি উনার কাছ থেকে যতটা পারি শিখে নেই।’
এইভাবে দুজনেই যদি দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভাবেন, তাহলে সম্পর্কটা অনেক সুমধুর হয় এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনে অনেক সহজ হয়।দুজনের ইচ্ছাই পূরণ হয় ও দুজনেই যে নিরাপত্তা বোধের অভাব বোধ করছিলেন, সেটা কমে।
২) স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যাক। দৈনন্দিন জীবনে উভয়ের কাছ থেকেই উভয়ের নানা রকমের প্রত্যাশা ও চাহিদা থাকে। স্বামী সারাদিন পরিশ্রম করার পর বাড়িতে এসে মনে করতে পারেন যে, ‘আমার একটু আরামের প্রয়োজন এবং বাড়ির আবহাওয়া যাতে শান্তিপূর্ণ থাকে।’ কিন্তু সেইসঙ্গে তাকে তার স্ত্রীর কথাও ভাবতে হবে। যেমন তার স্ত্রীও সারাদিন পরিশ্রম করে বাড়িতে আসছেন। তারও বিশ্রামের প্রয়োজন বা তার সঙ্গের প্রয়োজন। সুতরাং হাতে হাতে একটু কাজ করে দেওয়া, বা একসঙ্গে বসে রাতের খাবার খাওয়া, স্ত্রীকে একটু সময় দেওয়া ইত্যাদি দরকার।
ঠিক তেমনই স্ত্রীকেও স্বামীর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভাবতে হবে যেমন, সারাদিন পরিশ্রম করে তিনি বাড়িতে আসছেন, সুতরাং আসবার সাথে সাথে বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে সমালোচনা করতে শুরু করা বা যা যা অসুবিধা হচ্ছে তা বলতে শুরু করা, সব সময় কমপ্লেন করা, ইত্যাদি না করে কিভাবে একসাথে ভালো সময় কাটানো যায় সেটা ভাবতে হবে।
৩) সন্তান ও অভিভাবকের সম্পর্ক উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যাক। আমরা অভিভাবকরা বেশিরভাগ সময়েই সন্তানদের সাথে নির্দেশ মূলক সুরে কথা বলি। মানে ‘এটা করো, ওটা কোরোনা, এভাবে করো ওভাবে কোরোনা’ ইত্যাদি। আমরা ওরা বড় হলেও ভুলে যাই যে, ওদের নিজেদের একটা জীবন আছে, নিজেদের ইচ্ছে অনিচ্ছে আছে, নিজেদের প্রাইভেসি আছে। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের জীবনকে সব সময় নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, এবং ভাবি যে ওরা আমাদের হাতের বাইরে চলে যাবে। কিন্তু ছেলেমেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে, আমরাও একসময় ওদের সময় দিয়ে পার হয়েছি। ওদের আজকে যা যা করতে ইচ্ছা করছে, ওরা যেটুকু স্বাধীনতা চাইছে, সেটুকু আমরাও এক সময় চেয়েছিলাম। তাই ওদেরকে ওদের মতন করে বন্ধুর মতো পরিচালনা করাই দরকার।
অপরপক্ষে ছেলেমেয়েদেরও ভাবা প্রয়োজন যে, বাবা মা আমাদের থেকে অনেক বেশি অভিজ্ঞ এবং জীবনকে অনেক বেশি দেখেছেন। তাই তারা যেটা বলছেন তা আমাদের ভালোর জন্যই বলছেন। তারা কখনোই আমাদের খারাপ চান না। আমাদের মুখের হাসিটুকুই তাদের জীবনের লক্ষ্য। তাই বাবা-মা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েও আমাদের ভাবা দরকার।
৪) কর্তৃপক্ষ এবং কর্মচারীর উদাহরণ নেওয়া যাক। কর্তৃপক্ষকে কর্মচারীর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েও দেখতে হবে। যেমন, তাদের সুবিধা-অসুবিধা, তাদের ইচ্ছে অনিচ্ছে, তাদের ভালোলাগা খারাপ লাগা ইত্যাদি। তাকে কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় স্বাধীনতাটুকু দিতে হবে এবং বুঝতে হবে যে কর্মচারীদের সুবিধে দেখলে আখেরে তারই উৎপাদন আরও বাড়বে।
ঠিক তেমনই কর্মচারীকেও কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি ভঙ্গি দিয়ে বিচার করে দেখতে হবে যে, সর্বতোভাবে কাজের মান কিভাবে উন্নত করা যায়। এটা বুঝতে হবে যে কর্তৃপক্ষের পক্ষে প্রত্যেক কর্মচারীকে আলাদা ভাবে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ তিনি একাধারে পুরো পরিষেবা সামলাচ্ছেন। এটাও বুঝতে হবে যে কর্তৃপক্ষ তার কাজের উন্নতির জন্য তাকে বলতে পারেন এবং এর পেছনে তার উদ্দেশ্য সৎ, এবং আখেরে তার নিজের কাজেরই উন্নতি হচ্ছে।
অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও পারিপার্শ্বিকতাকে দেখুন। নিজের ভালো থাকার জন্যই এটি প্রয়োজন।
লেখক : পুষ্পিতা মুখার্জি (মনোবিদ ও শিক্ষিকা)