নিজস্ব প্রতিনিধি: বাংলার শ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিধান চন্দ্র রায় চিরদিন বাঙালির মণিকোঠায় ছিলেন, আছেন, থাকবেন। আজকের রাজনীতিবিদদের চেয়ে অনেক-অনেক স্বতন্ত্র ছিলেন তিনি। জ্যোতি বসু কিংবা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো উন্নাসিক ছিলেন না। ঔদ্ধত্যের ছিটেফোটাঁ ছি না তাঁর ব্যবহারে। বরং নিপাট এক সজ্জন মানুষ। আজকের রাজনেতাদের মতো তিনি সাংবাদিক বান্ধব ছিলেন না। বরং পারত পক্ষে সাংবাদিকদের এড়িয়েই চলতেন। খুব সহজে সেজেগুঁজে ক্যামেরার সামনে পোঁজ দিতেন না (যেমন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সচরাচর দিয়ে থাকেন)। বিরোধীদের আক্রমণ করতে কখনই কুকথার স্রোত বইয়ে দিতেন না। তবে সাংবাদিকদের এড়িয়ে চললেও অসহিষ্ণু ছিলেন না মোটেও। বরং সমালোচনাকে গঠনমূলক আলোচনা বলেই মনে করতেন।
সাংবাদিক কিংবা সাহিত্য চর্চায় জড়িতদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে মেলামেশা করতেন না বটে, কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্বের পক্ষপাতী ছিলেন না কখনও। বরং অবাধ মতপ্রকাশ আর সাহিত্য চর্চার সুযোগ করে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। এই প্রতিবেদনে বাংলার শ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রীর সেই গুণের কথাই তুলে ধরা হচ্ছে। ব্রিটিশ শাসনামলের অবসান ঘটলেও যেহেতু রাজ্য প্রশাসন ও পুলিশে ব্রিটিশ জমানায় চাকরিতে ঢোকা পুলিশ আধিকারিক ও আমলারাই ছড়ি ঘোরাতেন, ফলে তাঁরা নিয়মের নামে বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করতেন। বিধান রায় যখন মুখ্যমন্ত্রী তখন লালবাজার থেকে একবার পত্রপত্রিকা ও বাংলা বইয়ে আপত্তিকর অংশ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা শুরু হয়। বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধ সান্যালদের মতো ভিন ধারার লেখকদের বেশ কিছু বই বাজেয়াপ্ত করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। ঘোর কংগ্রেসি হিসেবে পরিচিত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাসের দ্বারস্থ হলেন বুদ্ধদেব বসুরা। সবাই মিলে দল বেঁধে হাজির হলেন বিধান রায়ের অফিসে।
বাংলা সাহিত্যের দিকপাল লেখকদের মুখে সবটা শুনে বিস্মিত হয়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী।ব্যক্তিগত সহকারীকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, রুনুকে ডাকো। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব দুঁদে আইসিএস রুনু গুপ্ত ঢুকতেই কিছুটা তিরস্কারের স্বরে বিধানবাবু বলে উঠলেন, এ সব কী হচ্ছে? তুঘলকি কাণ্ড চলছে শুনছি। বিখ্যাত লেখকদের বই পুলিশ বাজেয়াপ্ত করছে, গ্রেফতারের ভয় দেখাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র সচিব রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। সেই যুক্তিকে পাত্তাই দিলেন না বিধান রায়। বজ্র কঠিন কণ্ঠে আদেশ দিলেন, ‘ওসব আইন-টাইন দেখাতে যেও না। সব দেখে নিয়ে প্রয়োজনে পাল্টে দাও।’ মুখ্যমন্ত্রীর আদেশ শোনার পরে পাল্টা যুক্তি দেখানোর সাহস পেলেন না দুঁদে আমলা। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অন্যান্য লেখকদের অভয় দিয়ে বিধানবাবু বললেন, ‘আমি বলে দিচ্ছি, পুলিশ আপনাদের আর বিরক্ত করবে না।’ বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কঠোর মনোভাব জানার পরে লেখকদের পিছনে লাগার দুঃসাহস দেখানো পথে হাঁটেননি পুলিশ আধিকারিকরা।