এই মুহূর্তে




কেন রাবণের মাথা কাটলে নতুন মাথা গজাতো ? জানুন লঙ্কাধিপতির  দশ মাথার রহস্য




পৃথ্বীজিৎ চট্টোপাধ্যায় : হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে অগণিত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল, যাঁদের মধ্যে লঙ্কাধিপতি রাবণ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। তিনি কেবলমাত্র এক প্রবল শক্তিশালী রাক্ষস রাজাই ছিলেন না, বরং এক অত্যন্ত জ্ঞানী, শিবভক্ত ও তপস্বী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর পিতা বিশ্বশ্রবা মুনি এবং মাতা ছিলেন কৈকসী, যাঁর আরেক নাম ছিল নিকষা। লোকশ্রুতি অনুসারে দশানন নিকষার গর্ভে জন্মেছিলেন বলে তাঁকে নৈকষেয়’ও বলা হত। তাঁর বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব ও তাঁর দশটি মাথা নিয়ে যুগে যুগে নানা পৌরাণিক উপকথা ও ব্যাখ্যা প্রচলিত রয়েছে। কথিত আছে, তাঁর দশটি মাথা কেটে ফেলার পরও নতুন মাথা দিয়ে সেই কাটা মাথা প্রতিস্থাপিত হত। এর নেপথ্যে প্রধান কারণ ছিল তাঁর কঠোর তপস্যা ও ব্রহ্মার দেওয়া অভিশাপ সদৃশ বর।

প্রথমেই বলা দরকার, রাবণ ছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবের পরম ভক্ত। তিনি শিবকে তুষ্ট করতে এতটাই কঠোর তপস্যা করেছিলেন যে, নিজের মাথা একে একে দশবার কেটে শিবের চরণে অর্পণ করেছিলেন। শিব তার এই ত্যাগ ও নিষ্ঠা দেখে খুশি হয়ে ব্রহ্মাকে নির্দেশ দেন রাবণকে অমরত্বের বর দিতে। তখন ব্রহ্মা রাবণকে আশীর্বাদ করেন যে, যদি তাঁর কোনও শত্রু তার মাথা কেটে ফেলে, তবে সেই মাথা পুনরায় গজিয়ে উঠবে। ফলে রাবণের মাথা যতবারই কাটা হোক না কেন, সাথে সাথে নতুন মাথা বেরিয়ে আসত।

এই বর রাবণকে একপ্রকার অমরত্বেরই সমান শক্তি দিয়েছিল। সেই সময় রাবণ ভেবেছিলেন, কেউ কখনও তাকে হারাতে পারবে না। তবে অমরত্বের এই বর পাওয়ার সময়েই তিনি বড় একটি ভুল করে বসেন। তিনি ব্রহ্মার কাছে এমন বর চেয়েছিলেন যাতে দেবতা, দানব, যক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নর কেউ তাকে বধ করতে না পারে। মানুষ ও বানরকে তিনি তুচ্ছ মনে করে এই তালিকায় রাখেননি। এটাই তাঁর  সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, যা পরবর্তীতে পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

রাবণের দশটি মাথার ব্যাখ্যা নিয়েও প্রচুর বিতর্ক ও মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, দশটি মাথা ছিল রাবণের দশ গুণ বা বৈশিষ্ট্যের প্রতীক, আবার কেউ বলেন, চারটি বেদ এবং ছয়টি শাস্ত্রের জ্ঞানের প্রতীক। অন্যদিকে, অনেক পুরাণবিদ বলেন, এই দশটি মাথা রাবণের দশটি রিপু বা চারিত্রিক দুর্বলতার প্রতীক, যা তার পতনের পথ প্রশস্ত করেছিল। এই রিপুগুলি হলো:

১) কাম (অতৃপ্ত বাসনা)

২) ক্রোধ (অসীম রাগ)

৩) লোভ (অপার লালসা)

৪) মোহ (মায়ার মোহ)

৫) মদ (অহঙ্কার)

৬) মাৎসর্য (হিংসা)

৭) অহঙ্কার (অহমবোধ)

৮) জড়তা (অবিবেচনা)

৯) ঘৃণা (অন্যের প্রতি বিদ্বেষ)

১০) ভয় (সব হারানোর আতঙ্ক)।

এই দশটি মানসিক রিপু একসাথে রাবণের দশমুখের রূপে চিত্রিত হয়েছে, যা তাকে মহাজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।

রাবণের এই দশমুখ শুধুমাত্র পৌরাণিক গল্পে নয়, ভারতীয় শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হয়ে আছে। উত্তর ভারতে দশেরা উৎসবে তার কুশপুত্তলিকা দাহের মাধ্যমে অহঙ্কার, লোভ, ক্রোধ প্রভৃতি রিপুর দহন এবং ন্যায়ের বিজয়ের বার্তা দেওয়া হয়।

রাবণের দশমুখ কাহিনির আরেকটি দিক হল তাঁর পুষ্পক রথ। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী, রাবণই প্রথম ব্যক্তি, যিনি আকাশে উড়তে সক্ষম যানবাহন পুষ্পক রথ ব্যবহার করেছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায়, তার প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও জ্ঞানের গভীরতা কতটা বিস্তৃত ছিল। তবুও তার মাথা পুনরায় গজিয়ে ওঠার বরও তাকে শেষ রক্ষা করতে পারেনি। কারণ তার অন্তর্লালিত অহংকার ও রিপুগুলি তাকে অন্ধ করে দেয়, যার পরিণতিতে শ্রীরামচন্দ্রের হাতে তার পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।

সবশেষে বলা যায়, রাবণের মাথা কেটে দিলে আবার গজিয়ে ওঠার রহস্য ছিল তাঁর কঠোর তপস্যা, ব্রহ্মার বর এবং তার অতিমানবীয় শক্তির প্রতীক। কিন্তু তার দশটি মাথা আমাদের শেখায়, জ্ঞান, ক্ষমতা ও শক্তি থাকার পরও যদি মানুষের মধ্যে অহঙ্কার ও রিপু বাসা বাঁধে, তবে তাঁর পতন নিশ্চিত। রাবণের গল্প তাই একদিকে যেমন পৌরাণিক রোমাঞ্চের নিদর্শন, তেমনই মানবজাতির জন্য এক চিরন্তন শিক্ষা।

Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

পরিচয় ভাঁড়িয়ে ‘আব্দুল’ হয়ে গেলেন ‘নেহা’, ১০ বছর ঘাঁপটি মেরে বসবাসের পর গ্রেফতার বাংলাদেশি যুবক

ট্রাম্পের সঙ্গে বিবাদ, ফোন নম্বর বদলে ফেললেন মাস্ক

গুগলে ৫৪ লক্ষের বেতনে যোগ দিলেন জলপাইগুড়ির শ্রেয়া, গল্প শুনলে চোখে জল আসবে

লুকানো হৃদরোগ শনাক্তে কার্ডিওলজিস্টদের চেয়েও নির্ভুল এই নতুন AI টুল

জানেন কী, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে একমাত্র এই কৌরব যুদ্ধ করেছিলেন পাণ্ডবদের হয়ে?

জানেন, কেন লক্ষ্মীদেবী সবসময় ভগবান নারায়ণের পায়ের কাছে বসেন?

Advertisement
এক ঝলকে
Advertisement

জেলা ভিত্তিক সংবাদ