এই মুহূর্তে




প্রলয়ের বার্তা শুনে পিনাক নিক্ষেপ করেছিলেন দেবাদিদেব, জেনে নিন মারণাস্ত্রের পৌরাণিক কাহিনি 




পৃথ্বীজিৎ চট্টোপাধ্যায় : মহাজগতের বীজ ধারণকারী ও ধ্বংসের কর্তা আদি অনন্ত দেবাদিদেব মহাদেবের মহাশক্তিশালী ধনু পিনাক, যা হরধনু নামেও পরিচিত, হিন্দু ধর্মের অন্যতম বিখ্যাত অস্ত্র। এটি ভগবান শিবের স্বর্গীয় ধনুক, যার উল্লেখ বিভিন্ন পৌরাণিক গ্রন্থ, রামায়ণ এবং অন্যান্য বহু প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায়। কথিত আছে দেবদবকে “পিনাকপাণি” বলা হয়ে থাকে, যে শব্দের অর্থ হল— যাঁর হাতে পিনাক রয়েছে। এটি শুধু শিবের অস্ত্র নয়, তার প্রলয় ও ধ্বংসের শক্তিরও প্রতীক।

পুরাণ মতে, দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা দুটি দিব্যধনুর নির্মাণ করেন। একটি দেবাদিদেব শিবের জন্য এবং অন্যটি জগৎপালক বিষ্ণুর জন্য নিবেদন করা হয়। শিবের ধনুক ছিল পিনাক এবং বিষ্ণুর ধনুক ছিল শার্ঙ্গ। পরে প্রজাপতি ব্রহ্মা কৌতূহলবশত শিব ও বিষ্ণুর শক্তি নির্ণয়ের জন্য তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধানোর চেষ্টা করেন। যুদ্ধের প্রস্তুতিকালে আকাশবাণী হয় যে, এই লড়াই ভয়ঙ্কর প্রলয় ডেকে আনবে। এই সতর্কবার্তা শুনে শিব তার ধনুক নিক্ষেপ করেন, যা পরে পৃথিবীতে এসে পড়ে এবং হরধনু নামে প্রসিদ্ধ হয়।

পরবর্তীকালে এই ধনুক মিথিলার রাজা দেবরথের অধীনে আসে এবং বংশানুক্রমে জনক রাজবংশে রক্ষিত হয়। রাজা জনকের শাসনকালে পিনাক মিথিলার রাজকোষের শ্রেষ্ঠতম ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষিত ছিল। জনকের কন্যা জানকী তথা সীতা একদিন শিশুকালে অনায়াসে এই বিশাল ধনুক তুলেছিলেন। এতে অভিভূত হয়ে রাজা জনক প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যিনি এই ধনুক তুলতে এবং গুণ পরাতে সক্ষম হবেন, কেবল তিনিই সীতার স্বামী হবেন।

রামায়ণে বর্ণিত হয়েছে, সীতার স্বয়ম্বরসভায় বিশ্বের বিভিন্ন রাজা ও রাজকুমাররা এই ধনুক তুলতে ব্যর্থ হন। তখন অযোধ্যার রাজপুত্র রাম অতি সহজেই ধনুকটি তুলে ফেলেন এবং গুণ পরানোর চেষ্টায় সেটি ভেঙে ফেলেন। এই হরধনু ভঙ্গ করার ঘটনার মাধ্যমে রাম এবং সীতার বিবাহ সুসম্পন্ন হয়। এটি রামায়ণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক, কারণ এখান থেকেই রাম ও সীতার মিলন এবং পরবর্তীকালের রাম-রাবণের বিরোধের সূত্রপাত হয়।

পরবর্তীতে যখন শ্রীরাম, সীতা ও লক্ষ্মণ রাজা দশরথের সঙ্গে অযোধ্যায় ফিরে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে ঋষি পরশুরাম তাদের পথরোধ করেন। তিনি রামের কাছে হরধনু ভাঙার কৈফিয়ত চান এবং তাকে পরীক্ষা করতে বিষ্ণুধনু উপস্থিত করেন। রাম তাতে সহজেই গুণ পরান এবং পরশুরাম তার মধ্যে বিষ্ণুর অবতার রূপ চিনতে পারেন। এই ঘটনাটি রামায়ণে রামের পরম শক্তির প্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

আবার বিষ্ণু পুরাণে বর্ণিত  ভিন্ন একটি কাহিনি আছে, যেখানে বলা হয়েছে, একবার তারকাসুরের তিন পুত্র — তরকাক্ষ, কমলাক্ষ এবং বিদ্যুৎমালী দেবকূলে মহাবিপর্যয় সৃষ্টি করে। তখন দেবগণ শিবের শরণ নেন। শিব যুদ্ধের জন্য মেরু পর্বতকে ধনুক, আদি নাগকে ধনুকের প্রত্তঞ্চ এবং সরস্বতীকে ঘণ্টিকারূপে গ্রহণ করেন, বিষ্ণু নিজেকে বান রূপে রূপান্তরিত করেন। এই মহাযুদ্ধে পিনাকের সাহায্যে শিব ওই তিন অসুরকে পরাজিত করেন। পরে দেবতাদের অনুরোধে এই ধনুক শিব সংরক্ষণ করেন এবং ঘোষণা দেন — ত্রেতাযুগে বিষ্ণুর মানব অবতার (রাম) এই ধনুক ভঙ্গ করবেন, যা সৃষ্টি চক্রের ভারসাম্য রক্ষার জন্য অপরিহার্য হবে।

এই ঘটনাগুলি থেকে অতি সহজেই বোঝা যায়, পিনাক শুধু এক অস্ত্র নয়, এটি সনাতন ধর্মের ধ্বংস ও পুনঃসৃষ্টির চক্রের প্রতীক। শিবের প্রলয়কারী শক্তি, বিষ্ণুর পালন শক্তি এবং ব্রহ্মার সৃষ্টির ইঙ্গিত এই ধনুকের উপাখ্যানে নিহিত রয়েছে। এটি দেখায়, যথাস্থানে ধ্বংস অপরিহার্য, কারণ তার মাধ্যমেই নতুন সৃষ্টির পথ প্রশস্ত হয়। পিনাকের ভঙ্গও সেই বৃহত্তর ধর্মীয় সত্যের প্রকাশ — সমগ্র জগতই সৃষ্টি ও ধ্বংসের এই চক্রাকার নীতিতে আবর্তিত হয়ে আসছে।

 




Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

চেনেন কী ‘মৌমাছির দেবী’কে? জেনে নিন দেবী ভ্রামরীর অজানা কাহিনি

জেনে নিন, মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের নিয়ন্ত্রক শক্তি ভুবনেশ্বরীর মাহাত্ম্য

সাইফুল্লাহর শোকসভায় ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন পাক সেনার

ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে ‘আল্লাহ কে বান্দে …’ গেয়ে হিন্দুত্ববাদীদের হেনস্থার শিকার হিন্দু শিল্পী

রামমন্দিরের নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ জুনের মধ্যে, রাম দরবারের প্রাণ প্রতিষ্ঠা ৫ জুন

পাকিস্তানেই শিকড় জ্যোতিদের, সেই টানেই কী গদ্দারি ইউটিউবারের?

Advertisement




এক ঝলকে
Advertisement




জেলা ভিত্তিক সংবাদ