নিজস্ব প্রতিনিধি: ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর’। কিন্তু বাস্তবের চিত্ত(Chitta Burman) জেলের পাঁচিল বন্দি। মুক্ত সে আজও হতে পারেনি। উচ্চ নেই তাঁর শিরও। তবে সে ভয় শূন্য হয়ে গিয়েছে। কেননা তাঁর জীবনের ২০টা বছর বিনা দোষে কেটে গিয়েছে জেলের অন্দরে। প্রতিবেশী দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে নির্দোষ আখ্যা দিয়ে মুক্তির নির্দেশ দিলেও শুধুমাত্র সেই নির্দেশের নথি এপার বাংলায় এসে না পৌঁছানোর জন্য এখনও গারদের ওপারেই রয়ে গিয়েছেন রাজ্যের দক্ষিণ ২৪ পরগনা(South 24 Pargana) জেলার গোসাবার(Gosaba) বাসিন্দা তথা পেশায় মৎস্যজীবী চিত্ত বর্মণ। তিনি যে কবে মুক্তি পাবেন, তাও জানেন না। তাঁর পরিবার তাঁকে ভুলেছে, আপনজনেরা মুখ ফিরিয়েছে। জেলের বন্দিরাই এখন তাঁর প্রতিবেশী, নিত্যদিনের বেঁচে থাকার সঙ্গী। দেশ তাঁর স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন করছে। কিন্তু চিত্তকে স্বাধীন জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার কোনও প্রচেষ্টাই কেউ করেননি।
ঠিক কী হয়েছিল চিত্ত বর্মণের? ২০০৩ সালের ঘটনা। বাংলায় তখন বাম শাসন। সেই সময়েই একদল মৎস্যজীবীর সঙ্গে সুন্দরবনে(Sundarban) মাছ ধরতে গিয়েছিলেন চিত্ত। এক রাতে মাঝ নদীতে পড়েন যান তাঁরা বাংলাদেশী ডাকাতের মুখে। অনেককেই সেদিন খুন করেছিল ডাকাতদল। বাকি কয়েকজনকে তুলে নিয়ে চলে যায়। সেই ঘটনা চাঞ্চল্য ফেলে দিয়েছিল রাজ্যে। কড়া সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল বিএসএফ-কে। আপার বাংলা থেকেও বার্তা গিয়েছিল ওপার বাংলায়। তার জেরেই বাংলাদেশ(Bangladesh) কোস্ট গার্ডের জওয়ানরা অভিযান চালিয়ে চিত্তকে উদ্ধার করে। কিন্তু চিত্ত’র বাকি সঙ্গিরা কোথায় তা আজও জানেন না চিত্ত। দুর্ভাগ্যের কথা বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের জওয়ানরা চিত্তকে ভারতে না ফিরিয়ে তাঁকে বাংলাদেশের পুলিশের হাতে তুলে দেয়। বেআইনি অনুপ্রবেশ সহ একাধিক অপরাধের ধারায় চিত্তের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে বাংলাদেশ পুলিশ। কেন এমন করা হয়েছিল তার উত্তর আজও জানেন না চিত্ত। ২০০৩ থেকে ২০১৬ বিনা বিচারে বাংলাদেশের জেলে ১৩ বছর ধরে বন্দি ছিলেন চিত্ত।
২০১৬ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে যে বন্দি প্রত্যর্পণ হয়, তাতে ওপার থেকে বেশ কয়েকজন সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন বন্দিকে এপারে ফেরত পাঠানো হয়। যার মধ্যে ছিলেন চিত্ত বর্মনও। রাজ্যে আসার পর তাঁর ঠিকানা হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেল। সেই সময়েই চিত্ত যে জীবিত রয়েছেন তা জানতে পারেন তাঁর স্ত্রী শিবানী বর্মণ। তারপর শুরু হয় এপার বাংলায় আদলতে দৌড়ঝাঁপ। ২০১৭ সালে দেশের সব সংশোধনাগারের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। সেই মতো আইনজীবী তাপস ভঞ্জকে ওই মামলায় আদালতবান্ধব হিসাবে নিযুক্ত করে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। তিনি সেই মতো রাজ্যের সব সংশোধনাগার পরিদর্শন করেন। তখনই তিনি চিত্তের দেখা পান বারুইপুর সংশোধনাগারে। কেননা তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের বন্দিদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বারুইপুরে। চিত্ত বর্মনের বিষয়টি খোঁজ নিয়ে তাপসবাবু জানতে পারেন, চিত্ত প্রায় ২০ বছর জেলে থাকলেও ২০১৯ সালের ১৮ জুন তাঁকে বেকসুর খালাসের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট। সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবের ডিভিশন বেঞ্চে মামলার শুনানিতে বিষয়টি জানান তাপসবাবু। সব শোনার পর চিত্ত বর্মন এখনও কেন মুক্তি পাননি, এবিষয়ে রাজ্যের বক্তব্য জানতে চেয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। সূত্রের খবর, বাংলাদেশ থেকে ২০১৯ সালের সেই নির্দেশের কপি এখনও এসে না পৌঁছনোয় গরাদের ওপারেই রয়ে গিয়েছেন চিত্ত বর্মন। এ জীবনে তিনি আর স্বাধীন হতে পারবেন কিনা সেটাই সন্দেহ স্ত্রী শিবানীর।