নিজস্ব প্রতিনিধি, ঢাকা: লর্ড বায়রন, দস্তভয়েস্কির লেখার ভক্ত ছিল। নিজেও চেয়েছিল সাহিত্যিক হতে। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণের আগেই স্বার্থপর পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া। আত্মঘাতী হওয়ার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সুইসাইড নোট আপলোডও করেছে। আর ওই ফেসবুক স্ট্যাটাস ঘিরেই তোলপাড় পড়ে গিয়েছে। ইদানিং যেভাবে ফেসবুক লাইভে এসে কিংবা স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে তাতে যথেষ্টই উদ্বিগ্ন
বুধবার আত্মহত্যার আগে ফেসবুকে পর পর দুটি পোস্ট করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া ইশতিয়াক মাহমুদ পাঠান। প্রথম পোস্টে সে লিখেছে, ‘শুভ সকাল, লেখাটা যখন আপনারা পড়বেন, তখন আমি আপনাদের ছেড়ে অনেক দূরের, না ফেরার দেশের যাত্রী। আমি জানি, আপনাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা আমাকে ভালোবাসেন। হয়তো কোনও কারণ ছাড়াই বাসতেন। খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলাম না হয়তো কারও কাছে। তবে ছিলাম তো?
আবার অনেকেই আছেন যারা আমাকে ঘৃণা করতেন। কেন করতেন? আপনাদের মধ্য থেকে কেউ একজন আমাকে মাথায় তুলে আবার ছুড়ে ফেলেও দিয়েছেন। তাতেও কারও বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। আমার সমস্যা শুধু আমার নিজেকে নিয়ে। নিজের মনটাকে আর বুঝিয়ে রাখতে পারছিলাম না। মনের সাথে যুদ্ধ করে আমি বারবার হেরে যাচ্ছিলাম। রোজই মৃত্যু আমাকে তাড়া করছিল। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না; সেই কবে থেকে। গত কিছু দিন আমি অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করেও বাঁচতে চেয়েছি। ভরপুর বেঁচে থাকার স্বাদ ছিলো। সম্ভাব্য সব মানুষের কাছে বেঁচে থাকার আর্জি জানিয়েছি। আমি বারবার বাঁচতে চেয়েছিলাম।’
ইশতিয়াক আরও লিখেছেন, ‘আমি সবসময়ে একজন সাহিত্যিক হতে চেয়েছিলাম। লর্ড বায়রন, দস্তয়েভস্কি’র মতো অসাধারণ গল্প, উপন্যাস লিখে পাঠকদের মুগ্ধ করে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুধু এই ভয়ংকর লেখাটাই লিখতে পারলাম। আমি সাহিত্য, ছোট গল্প আর কবিতা ভালোবাসতাম।
একদিন আমি একটা মানুষকেও ভালবেসে ফেললাম! প্রথমবার এই চিঠি লিখছি। এবং শেষ বারও। আমায় ক্ষমা করবেন, আমার কথার যদি অর্থ না বোঝেন? শৈশবের একাকীত্বের অভাব আমি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। হতে পারে পৃথিবী আমার জন্য কঠিন ছিলো। আমি বুঝতে পারছি- আমি ভুল করেছি। আমাকে সবসময় যন্ত্রণার কাঁটাতারের উপর হাঁটতে হয়েছে। একটা জীবন এতো যন্ত্রণার কেন?! সেই সব মানুষেরা, যারা আপন মানুষের বেশ ধরে কাছে এসে বুকে হাত রাখে। তারপর চলে যাবার সময় হৃদপিণ্ডটা ছিড়ে নিয়ে যায়। অন্যের জীবন যাদের কাছে এতো মূল্যহীন তারা ভালো থাকে কি করে? না, আমি কষ্টে নেই এখন। আমার কোনও দুঃখ বোধও নেই। কোনও যন্ত্রণা নেই। আমি শূন্য। সব দুঃখ, কষ্টের অবসান হতে চলেছে। চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমেছে। একটু পরই ঘুমিয়ে যাব। একেবারে চিরকালের মতো। অতল থেকে অতলান্তে। নিজেকে নিয়ে আমি চিন্তিত নই। যেটা পেয়েছি আমি জানি সেটা কত ভয়ঙ্কর। আর সেই জন্যই আমি আজ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মানুষ হয়তো আমাকে বোকা বলবে, আমাকে ভীতু বলবে। আবার স্বার্থপরও বলবে। অথবা বলবে- আমি গাধা। কিন্তু আমাকে কে কি বলবে, না বলবে তাতে এখন আর আমার কিছু আসে যাবে না। এসব কিছু নিয়ে ভাবছি না। জীবন কঠিন যন্ত্রণা আর অবহেলার। মৃত্যু সেই সব থেকে মুক্তি দেয়। জীবনের চেয়ে মৃত্যু সহজ।’
শেষ ছত্রে ইশতিয়াক লিখেছে, ‘অপমান, অবহেলা আর লজ্জার সমস্যা স্তর পার করে তবেই নাকি ঘৃণার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়াতে হয়। আমি সেখানে দাঁড়িয়েও বাঁচতে চেয়েছিলাম.. একটা কুকুরের বাচ্চাও তো ব্যথা পেলে শব্দ করে উঠে। আমি তো মানুষ! ভালো থেকো- ভালোবাসারা।’
আর দ্বিতীয় পোস্টে লিখেছে একটাই শব্দ-‘বিদায়’।
ইতিমধ্যেই ইশতিয়াকের আত্মহত্যার ঘটনায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।