এই মুহূর্তে




জেনে নিন মহাদেবের অতি ভয়ঙ্কর রূপ কালভৈরবের মাহাত্ম্য




পৃথ্বীজিৎ চট্টোপাধ্যায় :         মহাকালং যজেদব্যং দক্ষিণে ধূমবর্ণকম।

                                             বিভ্রতং দন্ড খটাঙ্গৌ দংস্ট্রাভীমমূখম্ শিশুম্॥

                                              ব্যাঘ্রচর্মাবৃতকটীং তূন্দীলং রক্তবাসসম্।

                                              ত্রিনেত্রমূর্ধং কেশঞ্চ মুণ্ডমালা বিভূষিতম্।

                                               জটাভার লসচ্চচন্দ্র খন্ডমুগ্রং জলন্নিভম্॥”

সৃষ্টির বীজ ধারণকারী ও ধ্বংসের কর্তা দেবাদিদেব মহাদেবের অসীম শক্তিশালী রহস্যময় এক ভয়ঙ্কর রূপ হলেন কালভৈরবযিনি হিন্দু ধর্মের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। জানা যায়, ‘ভৈরব’ শব্দটি সংস্কৃত “ভয়” এবং “রব” শব্দের সমন্বয়ে গঠিত, যার অর্থ ‘ভয়ানক চিৎকার’ বা ‘ভয়প্রদ সত্তা’। তিনি শিবের হিংস্র অবতার হিসেবে পরিচিত এবং সময়, মৃত্যু, ধ্বংস, সংহার এবং পুনর্জন্মের রূপক হিসেবে পূজিত হন। হিন্দু শাস্ত্রে তাঁরই আরেক নাম মহাকাল। যেহেতু তিনি সর্ব কালের কর্তা, তাই তাঁকে মহাকাল ভৈরব’ও বলা হয়ে থাকে।

কালভৈরবের সৃষ্টি কাহিনি

শিব পুরাণ অনুসারে, একবার সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতি ব্রহ্মা অহংকারে পূর্ণ হয়ে শিবের চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করতে থাকেন। শিব সেই অহংকার দমনে রাগান্বিত হয়ে নিজের নখ থেকে কালভৈরব সৃষ্টি করেন। কালভৈরব ব্রহ্মার কাছে গিয়ে তাঁর পঞ্চম মাথা কেটে দেন। এই মাথা কেটে নেওয়ার ফলে শিবের ওপর ব্রহ্মহত্যার পাপ পড়ে। ফলস্বরূপ, কালভৈরবকে কপাল হাতে নিয়ে ভিক্ষা করতে হয় এবং তিনি কাশীধামে ব্রহ্মহত্যার পাপ থেকে মুক্তি পান। এই ভ্রাম্যমাণ রূপই কালভৈরব।

কালভৈরবের রূপ ও বৈশিষ্ট্য

কালভৈরবকে সাধারণত অতি ভীষণ ভয়ঙ্কর রূপে চিত্রিত করা হয়—তিনি খুলির মালা পরে থাকেন, হাতে ত্রিশূল, কৃপাণ এবং খঞ্জর ধারণ করেন। তাঁর বাহন একটি কালো কুকুর, যা তাকে চতুর, সাহসী ও নির্ভীকতার প্রতীক করে তোলে। তাঁর দৃষ্টিতে রয়েছে তীব্র জ্বলন, এবং মুখে হিংস্রতা, কিন্তু ভক্তদের প্রতি তিনি অত্যন্ত দয়ালু। কথিত আছে তাঁর কালো কুকুরটির নাম শ্বন।

ধর্মীয় গুরুত্ব ও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা

কালভৈরব শুধুমাত্র সংহারের প্রতীক নন, বরং তিনি সময়ের অধিপতি। ‘কাল’ শব্দটির অর্থই সময় এবং মৃত্যুকে বোঝায়। সময়ের মতোই তিনি ধ্বংস ও সৃষ্টি উভয়ের ধারক। তিনি জীবনের সীমা নির্ধারণ করেন এবং নিয়মিত সময়চক্রকে চালনা করেন। সময়ের উপর কর্তৃত্ব থাকায়, তাঁকে স্মরণ করলে জীবনের দিকনির্দেশনা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অর্জন সম্ভব হয়।

ভৈরবের রূপভেদ

শাস্ত্র অনুযায়ী, ভৈরবদের মোট সংখ্যা ৬৪ এবং এরা আটটি শ্রেণিতে বিভক্ত। এই আট শ্রেণির প্রতিটি একটি করে প্রধান ভৈরবের অধীনে পরিচালিত হয়, যাদের বলা হয় ‘অষ্ট ভৈরব’। তারা হলেন:

  • অসিতাঙ্গ ভৈরব
  • রুরু ভৈরব
  • চণ্ড ভৈরব
  • ক্রোধ ভৈরব
  • উন্মত্ত ভৈরব
  • কপালি ভৈরব
  • ভীষণ ভৈরব
  • সংহার ভৈরব

এই অষ্ট ভৈরব আবার নিয়ন্ত্রিত হন ‘মহা স্বর্ণ কালভৈরব’-এর দ্বারা, যিনি প্রধান কালভৈরব রূপে পরিচিত।

উপাসনা ও পূজা পদ্ধতি

কালভৈরবের পূজা সাধারণত সন্ধ্যাকালে সরিষার তেলের প্রদীপ, জুঁই ফুল, বেল পাতা, নারকেল এবং নিমপাতা দিয়ে করা হয়। কালো কুকুরকে খাওয়ানো হয় এবং নিরামিষ আহার দিয়ে পূজার আয়োজন করা হয়। পূজার দিনে কালভৈরবের মন্ত্র উচ্চারণ এবং তন্ত্র অনুসারে নিয়মিত পূজা করলে রোগ, শত্রু, আর্থিক কষ্ট এবং মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

কালভৈরব জয়ন্তী

প্রতি বছর মার্গশীর্ষ মাসের কৃষ্ণ অষ্টমীতে পালিত হয় ‘কালভৈরব জয়ন্তী’। এই দিনে ভক্তরা উপবাস পালন করেন, কালভৈরবের নাম স্মরণ করেন এবং রাত্রিকালীন পূজা করেন। এই উৎসব কাশী, উজ্জয়িনী, চেন্নাই, ভুবনেশ্বর ও কলকাতায় বিশেষভাবে পালিত হয়।

বিখ্যাত কালভৈরব মন্দির

ভারতের বিভিন্ন স্থানে কালভৈরবের বিখ্যাত মন্দির রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • কাশীর কালভৈরব মন্দির, বারাণসী: তাঁকে কাশীর কোতোয়াল (প্রধান রক্ষক) হিসেবে পূজা করা হয়।
  • উজ্জয়িনীর কালভৈরব মন্দির, মধ্যপ্রদেশ: এখানে মদ্য (অ্যালকোহল) অর্পণ করে পূজা করা হয়।
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়া কালভৈরব মন্দির, বাংলাদেশ: স্থানীয় হিন্দুদের মধ্যে এটি একটি প্রাচীন ও পূজিত স্থান।
  • কলকাতার কালভৈরব মন্দির: শহরের গুরুত্বপূর্ণ তান্ত্রিক পূজার কেন্দ্রগুলির একটি।
  • এছাড়া নেপালের কাঠমান্ডু দরবার স্কোয়ারের (Basantapur Durbar Square) একটি বিখ্যাত তীর্থস্থান হল কালভৈরব মন্দির। এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত।

কালভৈরবের তান্ত্রিক গুরুত্ব

তন্ত্রশাস্ত্রে কালভৈরব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। তাঁকে রহস্য বিজ্ঞান, গুপ্তচর্চা, যোগসাধনা এবং জ্ঞানচর্চার রক্ষক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তান্ত্রিক বিশ্বাসে, কালভৈরব সাধনার মাধ্যমে সিদ্ধি লাভে সহায়তা করেন এবং সকল প্রকার বাধা দূর করেন।

নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, শ্রী কালভৈরব হলেন এমন এক দেবতা যিনি একাধারে সময়, ধ্বংস এবং রক্ষা-এই তিনটি শক্তির আধার। তিনি ভয়ঙ্কর হলেও ভক্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সহজে সন্তুষ্ট হন। কালভৈরব পূজা শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং জীবনের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সময়ের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। হিন্দু ধর্মে তাঁকে পূজা করার মাধ্যমে একজন ভক্ত জীবনের অনিশ্চয়তা, ভয় এবং প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে সক্ষম হন। তাঁর রূপ, শক্তি ও উপাসনার মাধ্যমে প্রকাশ পায় শিবতত্ত্বের এক গভীর, অতল রূপ—ভয়কে জয় করার মহাশক্তি। জয় শ্রী শ্রী কালভৈরব।  হর হর মহাদেব।




Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

ভারতে একাধিক হামলার মাস্টারমাইন্ড, পাকিস্তানে নিহত লস্কর সন্ত্রাসী

প্রথমে দিয়েছিল ঋণ, এখন ১১টি শর্ত চাপিয়ে পাকিস্তানকে সতর্ক করল আইএমএফ

মৃত্যু যেন ওঁত পেতেছিল! খাটিয়ায় ঘুমন্ত যুবকের মাথায় কাল কেউটের ‘ছোবল’

জ্যোতি মালহোত্রা মামলায় নয়া মোড়, এবার আইবি’র নজরে জগন্নাথধামের ইউটিউবার

শিবতাণ্ডব স্তোত্রে ভরসা রেখে জঙ্গি ধ্বংস করেছিল ভারতীয় সেনা, অপারেশন সিঁদুরের সেই ভিডিও প্রকাশ্যে

পহেলগাঁও হামলাতেও কি হাত ছিল জ্যোতির, ভিডিও সামনে আসতেই হল পর্দাফাঁস

Advertisement




এক ঝলকে
Advertisement




জেলা ভিত্তিক সংবাদ