এই মুহূর্তে

সত্যজিৎ রায় ও কিছু কথা

সিদ্ধার্থ সাঁতরা:  “ ভালো বই পড়া, ভালো ছবির প্রদর্শনীতে যাওয়া  বা গানের আসরে বসে ভালো গান শোনা – এসবের  তাগিদ তাঁরাই বোধ করেন, যাঁরা ভালো ছবি, ভালো বই বা ভালো গানের কদর করেন বা করার চেষ্টা করেন।  কিন্তু সিনেমার  ব্যাপারে দেখি যাঁরা ‘সংগম’ দেখছেন তাঁরাই আবার ‘লা দোলচে ভিতা’তেও উঁকি দিচ্ছেন। এতে অবিশ্যি বলবার কিছু নেই—কারণ পকেটে পাঁচসিকা পয়সা এবং হাতে ঘণ্টা তিনেক সময় থাকলে যে কেউ যে কোনও ছবিই দেখতে পারেন এবং তা নিয়ে মন্তব্য করতে পারেন। মন্তব্য যদি কফি হাউসে বা পাড়ার রকে নিবদ্ধ থাকে তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু রাম-শ্যাম-যদু সকলেই যদি পত্র-পত্রিকায় তাঁদের ভয়ংকরী বিদ্যার পরিচয় দিতে শুরু করেন তবে আশঙ্কা হয় যে যখন সবে বাংলা দেশের দর্শকের মধ্যে সিনেমার বিষয় জানবার ও শেখবার একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতারও কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তখন এসব লেখা অন্তত কিছু সংখ্যক পাঠক তথা দর্শকের মনে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে না কি ?”

-সত্যজিৎ রায়   (Satyajit Ray)

 

জন্ম ২ মে ১৯২১ , মৃত্যু ২৩ এপ্রিল ১৯৯২। পিতা সুকুমার রায়, মাতা সুপ্রভা দেবী।                প্রেসিডেন্সী কলেজ ও শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা করে সত্যজিৎ রায় একটি ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী সংস্থায় ১৯৪৩ সালে যোগ দেন ও পরে ১৯৫০ সালে তিনি ঐ সংস্থার আর্ট ডিরেক্টর হন। ভারতে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন গড়ে ওঠার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন তিনি। ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটিজ  অফ ইন্ডিয়ার আমৃত্যু সর্বভারতীয় সভাপতির দায়িত্ব সামলেছেন।  জন্ম শতবর্ষে আমাদের গর্ব  সত্যজিৎ রায়ের কাজ নিয়ে দেশে বিদেশে অনেক আলোচনা নানা জায়গায় হবে সেই প্রেক্ষিতে আমার শ্রধাঞ্জলি এই ছোট্ট আলোচনা পাঠকের উদ্দেশ্যে রাখলাম।

চলচ্চিত্রে তিনি স্বরাজ্যে সম্রাট। ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী প্রবাদপ্রতিম এই স্রষ্টা নিজেই এক প্রতিষ্ঠান। বিশিষ্ট চিত্র-সমালোচক  ও তাত্ত্বিক ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ এক আলোচনায় লিখেছেন বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের যে অবদান বাংলা সিনেমায় সত্যজিতের সেই অবদান । ১৯৪৯ সালে বিখ্যাত ফরাসি চিত্র-পরিচালক জঁ রেনোয়া  ভারতে আসেন তাঁর দ্য রিভার ছবির শুটিং করতে। দেখা হয় সত্যজিতের সঙ্গে। সত্যজিতের চলচ্চিত্র চর্চার শিক্ষানবিশি হয়েছিল রেনোয়ার এই দ্য রিভার ছবিতে। এরপর সত্যজিৎ ১৯৫০ সালে লন্ডন যান এবং সেখানে ভিত্তেরিও ডি সিকার বিখ্যাত ছবি “বাইসাইকেল থীভস” দেখে মুগ্ধ হন এবং দেশে ফিরে ছবি তৈরির কাজ শুরু করেন। সত্যজিৎ রায় ‘দেশ , শারদীয় ১৯৬২’র  এক প্রবন্ধে লিখেছেন “বিজ্ঞাপনের কাজ ছেড়ে যখন সিনেমার কাজে অগ্রসর হই তখন আমার কাছে চলচ্চিত্রের প্রধান আকর্ষণ ছিল শিল্পের আকর্ষণ। অবশ্যি সেই শিল্প মারফত কায়েমি ভাবে একটা রোজগারের বন্দোবস্ত হতে পারে এমন আশাও ছিল। কাজের আনন্দ এবং কাজের পারিশ্রমিক, এই দুই-এরও অতিরিক্ত কিছু যে চলচ্চিত্র থেকে লাভ হতে পারে সেটা গোড়ায় জানা সম্ভব ছিল না ”।  ১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালি নির্মাণ দিয়ে শুরু করে ১৯৯১-এ আগন্তুক পর্যন্ত দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছর যে সহজাত সাবলীলতায় ছবি করে গেছেন যা তাবৎ বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছে বারবার। দেশ বিদেশের নানা সম্মান তাকে প্রতিনিয়ত আলোকিত করেছে।  চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি সাহিত্য রচনা করে গেছেন এবং সেখানেও তিনি সমান ভাবে সফল। গোয়েন্দা গল্প ও শিশু সাহিত্যে তার সাফল্য আমাদের কাছে এক বিস্ময়। তাঁর সৃষ্টির দিগন্ত ছোঁয়া জগৎ আমাদের বিস্মিত করে। আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় সত্যজিৎ রায়। তিনি তার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও অভিঘাতের দ্বারা ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক জীবনে এক উজ্জ্বল স্থান অধিকার করে রয়েছেন।

বিশ্ব চলচ্চিত্রে তিনি ছিলেন সমসাময়িক প্রথম সারির চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে অন্যতম।  ভারতবর্ষে তাঁর মতো  জাতীয় জীবনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলি নিয়ে এত নানা ধরনের কাজ আর কোন চলচ্চিত্রের স্রষ্টা করেছেন বলে আমার জানা নেই। তাঁর ছবির সৌন্দর্য, শুদ্ধতা ও ভারসাম্য ছবিগুলির মূল দুই উপাদান কাহিনীগত এবং গঠনগত বিষয়ের সম্মিলিত ভারসাম্যের ফল। সাহিত্যনুসারী হলেও তিনি কখনই শুধুমাত্র গল্প পরিবেশক নন। সত্যজিৎ তাঁর ছবির গল্প বেছে নিয়েছেন প্রচলিত গল্প উপন্যাস থেকে কিন্তু চিত্রায়িত করার সময় সেই গল্প নিজের ভাবনায় ও উপলব্ধির নিজস্বতায় সাজিয়ে গুছিয়ে তা চিত্রায়িত করেছেন।  যেমন পিকুর ডায়েরি ছিল ডায়েরিধর্মী আঙ্গিকে লেখা এবং ছোটো পিকুর ভাবনার অনুসারী কিন্তু সত্যজিৎ যখন ‘পিকু’ ছবি করলেন সেখানে শিশুর দৃষ্টিকোণ একাধিক দৃষ্টিকোণের একটি।  গল্পে যা ছিল নীল মাছি সিনেমায় তা কালো কালি দিয়ে সাদা ফুল আঁকার অনুষঙ্গে রূপ পেয়েছে।  বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধ্রুপদী উপন্যাস পথের পাঁচালি  ও অপরাজিত-র কেন্দ্রীয় চরিত্র অপুকে অবলম্বন করে সত্যজিৎ রায়ের তৈরি পথের পাঁচালি  (১৯৫৫), অপরাজিত (১৯৫৬) ও অপুর সংসার (১৯৫৯) এই তিন ছবিকে একত্রে অপু-ত্রয়ী বলা হয়।  অপু-ত্রয়ীর গুরুত্ব শুধু ছবির নন্দনতাত্ত্বিক অসাধারণত্বের জন্যই নয় বরং ওই ছবি একটা মতবাদ ভেঙ্গে আর একটা মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে যেটি হলো  ব্যাক্তিগত সংগ্রামের দ্বারাও পরিবর্তন আনা সম্ভব। সত্যজিতের ভাষায় ভারতীয় গ্রামীণ জীবনযাত্রার বিশ্বকোষ যে বই তার থেকে উপাদান নিয়ে যে মতবাদ  তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন তার জন্যই ছবির নন্দনতাত্ত্বিক অসাধারণত্ব সম্ভব হয়েছে। পথের পাঁচালি সত্যজিৎ রায়ের তৈরি প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘের কাহিনীচিত্র। ছবিটি দেশে-বিদেশে অভাবনীয় প্রশংসা ও নানা পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছে।  শৈল্পিক সাফল্য ও জনপ্রিয়তা উভয় বিচারে এই ছবিটিই ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের ছবি।  এই ছবির  হাত ধরে ভারতীয় চলচ্চিত্রে নতুন যুগের সূচনা হয়।   বিশিষ্ট চলচ্চিত্র-তাত্ত্বিক ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ এক জায়গায় লিখেছেন “ ১৯৬১ সালে নিউইয়র্ক শহরে  অপু-ত্রয়ীর সবগুলিই একসঙ্গে দেখার সুযোগ হয়। অপু-ত্রয়ী আমাকে ভারতের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছে । আর একটা কথা আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে চলচ্চিত্র কতদূর যেতে  পারে ’’।

সত্যজিৎ রায় একটি প্রবন্ধে লিখেছেন ‘পঁচিশ বছর ছবির কাজ করে এটুকু প্রত্যয় হয়েছে যে ভালো গল্প পেলে বা মাথায় এলে তাকে চলচ্চিত্রের ছাঁচে ঢেলে গুছিয়ে বলতে পারব’। তিনি রবীন্দ্রনাথের গল্পকে ভিত্তি করে ছবি করার সময়ও নিজস্ব অনুভবের ব্যাখ্যায় ছবি করেছেন। যেমন তিন কন্যা ছবির অন্তর্গত পোস্টমাস্টার অংশের মূল গল্পটি রবীন্দ্রনাথের। যেখানে গল্পের শেষে পোস্টমাস্টার চলে যাওয়ার সময় ছোট্ট পরিচারিকাটি তার পায়ে পড়ে বলছে –‘আমাকে ছেড়ে যেও না, তোমার সঙ্গে আমাকে নিয়ে যাও ।’ এটা সত্যজিতের কাছে ভাবপ্রবণতা বলে মনে হয়েছিল। এক সাক্ষাৎকারে এই প্রসঙ্গে সত্যজিৎ বলেছেন ‘ আমি তা ব্যক্ত করতে পারিনি, কারণ বিংশ শতাব্দীর মানুষ হয়ে অন্য পরিবেশে লালিত ও প্রভাবান্বিত হয়ে সেই আবেগ আমি অনুভব করি না। তাই আমি গল্পের শেষটা আরেকটু রুক্ষ করে দেখিয়েছি। আমি বরং গল্পে যেমন ছিল তার বিপরীতটাই দেখিয়েছি। ছবিতে মেয়েটি তার দুঃখ দেখানোর চেয়ে দুঃখ লুকিয়ে রেখেছে। সে পোস্টমাস্টারকে এড়িয়ে গেছে । সে এতো আহত হয়েছে যে সে এই লোকটিকে তার দুঃখের কথা বলেনি। সে কুঁয়োয় জল আনতে গিয়ে কাঁদছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে পোস্টমাস্টার তাকে ডাকলো তখনই সে চোখ মুছে ফেলল।  সে জলের বালতিটা নিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে গেল এবং পোস্টমাস্টার তাকে যে বকশিস দিতে গেল তাও সে উপেক্ষা করল। বিশ শতকের ষাটের দশকের শিল্পী হিসেবে এটাই আমার ব্যাখ্যা। শুদ্ধতাবাদীরা এই পরিবর্তনে আপত্তি জানায়। যেহেতু আমি একজন স্বতন্ত্র শিল্পী তাই আমি এরকম করে বদলে নিয়েছি।’ তাই বলা হয় সত্যজিতের সিনেমা চরম উৎকর্ষতায় শিল্পী সত্যজিতের সৃষ্ট একটি অখণ্ড সমগ্র।  যেমন ‘পথের পাঁচালি’ ছবির সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তগুলিতে সংলাপ যথাসম্ভব কম ব্যবহার করা হয়েছিল যদিও এই মুহূর্তগুলির সব কটিই মূল উপন্যাস থেকে নেওয়া। বিভূতিভূষণ এই মুহূর্তগুলি কাব্যময় করে তুলেছিলেন তাঁর ভাষার ব্যবহারে। সত্যজিৎ সেখানে সাহিত্যের বদলে চিত্রভাষার সাহায্য নিয়েছিলেন। একই কারণে অপু-দুর্গার প্রথম দেখা ট্রেন চলে শুধু মাঠের মধ্যে দিয়ে নয় কাশফুলে ভরা মাঠের মধ্য দিয়ে। একইভাবে দুর্গা যখন ইন্দিরের নির্জীব দেহ দেখে পিছিয়ে যায় তখন তার পায়ে লেগে ইন্দিরের কাঁসার ঘটিটি ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে ডোবার মধ্যে। আবার অপু তার দিদির চুরি করা পুঁতির মালা বাঁশ বনে না ফেলে পুকুরে ফেলে।  পুকুরের পানার আবরণে যে ফাঁকটি হয় তা যেন দুর্গার জীবনের একমাত্র অপ্রিয় ঘটনাটি গোপনের জন্য, যা আবার বন্ধ হয়ে যায়।   গাস্তঁ রোবের্জ লিখেছেন বিভূতিভূষণের লেখা ও সত্যজিতের ছবিকে তুলনা করলে দেখা যায় যে বিভূতিভূষণের পৃথিবী এক পরিবর্তনহীন, সময়হীন পুনরাবর্তনের পৃথিবী যার প্রতীক হলো নিরন্তর বয়ে যাওয়া নদীতে একটার পর একটা কুটো ভেসে যাচ্ছে –অপুর পর কাজল। অন্যদিকে সত্যজিতের পৃথিবী হলো গতিময় ও সময়সীমায় আবদ্ধ। এর প্রতীক হল রেলগাড়ি। সত্যজিতের পরিবর্তনে পুনরাবৃত্তি নেই। শৈশব থেকে বয়ঃপ্রাপ্তিতে অপু আলোকপ্রাপ্ত হতে থাকে এবং অপুর সংগ্রামে কাজলের জীবন তার বাবার জীবন থেকে আলাদা হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য  ডি. সিকার ‘বাইসাইকেল থীভস্‌’ ছবিতে দরিদ্র পরাজিত লোকটির ছেলেকেও তার বাবার পরাজয়ের শরিক হিসেবে টেনে আনা হয়েছে কিন্তু সত্যজিতের ছবিতে ছেলেকে তার বাবা টেনে উপরে তুলে এনেছে এবং একটা আত্মমর্যাদাপূর্ণ জীবনের আনন্দ ও মুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এই জায়গায় সত্যজিৎ সমসাময়িক নববাস্তববাদী অন্যান্য চিত্র নির্মাতাদের থেকে খানিকটা এগিয়েই রয়েছেন।

গুপী গাইন বাঘা বাইন( ১৯৬৮ )  ছবিটিও জনপ্রিয় ছবি , সপরিবারে বসে দেখার ছবি এবং চলচ্চিত্র হিসেবেও সার্থক ছবি।  এর গল্প রূপকথা, লেখক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। ফ্যান্টাসির ছোঁয়া , ছবির সাফল্য গল্পকে ছাপিয়ে যায় , সেখানে অদ্ভুত রস, স্বাদ, ও আবেদন, স্বতঃস্ফূর্ততা, নানা কল্পনাপ্রবণতার মিশ্রণ ছবিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। স্থান-কাল নিরপেক্ষ এই মিউজিক্যাল ছবিতে সময়, সমাজ ও দেশের জরুরি কিছু প্রাসঙ্গিকতা যা ভুতদের নৃত্যদৃশ্যের রূপকতা বা গানের কথাতে উঠে আসে। সবকিছুই একক বৈচিত্র্য স্বত্বেও ছবির সাবলীলতায় স্বছন্দে মিশে এক সার্থক সৃষ্টি হয়ে দর্শকের সামনে হাজির হয়েছে। এইরকমই আরেক অসাধারণ  ছবি হীরক রাজার দেশে ( ১৯৮০ )।

সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম সেরা ছবি ‘চারুলতা’ ( ১৯৬৪ )। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নষ্টনীড় গল্প অবলম্বনে তৈরি এই ছবি। মূল গল্পের ঘটনা, সংলাপ এবং চরিত্র এবং গল্পের থীম  অন্যান্য ছবির মত এ ছবিতেও পরিবর্তিত হয়েছে।  চারুলতা একটি মেয়ের ব্যাক্তিগত কাহিনী নির্ভর ছবি নয় বরং দেশকালজাত সমাজ ও সংস্কার এই ছবিতে সরাসরি উপস্থিত। মাধুর্য ও প্যাশন এই ছবির মত সত্যজিতের আর কোন ছবিতে এমন সার্থকভাবে সহাবস্থান করেনি  আর এই সমস্ত কিছুই উপস্থিত হয়েছে চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা ও পদ্ধতিতে। দৃশ্যগঠন , দৃশ্যের বিন্যাস, অভিনয় , সঙ্গীত সহ সবকিছুর সম্মিলিত বিচারে এই ছবি তাই এক অনন্য সৃষ্টি । এছাড়াও তাঁর ‘দেবী’, ‘সমাপ্তি’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ কিম্বা ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ ছবিগুলিতে তাঁর সাফল্য আবেগময়তা ও গভীর রসানুভূতিতে। আপেক্ষিকতা তাঁর নান্দনিক সমীকরণের একটি মূল উপাদান।  সত্যজিৎ রায়ের মত সমসাময়িক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষ খুব কমই দেখা যায়।  তাঁর ছবি রিয়েলিজম থেকে ক্রমেই নেচারালিজমের দিকে গিয়ে আবার রিয়েলিস্টিক। তাঁর শেষ তিনটি ছবি অর্থাৎ গণশত্রু ( ১৯৮৯ ), শাখাপ্রশাখা ( ১৯৯০ ) ও আগন্তুক ( ১৯৯১) আধুনিক সভ্যতা বিষয়ে  ছবি। সত্যজিৎ মনে করতেন শিল্পীর মূল কাজ হল অনুসন্ধান করা তাই তাঁর প্রায় সমস্ত ছবিই হল বাস্তবের অনুসন্ধান। আগন্তুক ছবিতে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার ভেতর তিনি ডুব দিয়েছেন, এ ছবিতে নির্মল আনন্দ আছে কিন্তু মননই এখানে প্রধান।  দূরদর্শনের জন্যও তিনি ছবি করেছেন ‘টু’ (১৯৬৪), ‘পিকু’ (১৯৮২) ও ‘সদ্গতি’ (১৯৮২) অসাধারণ সব ছবি।

চলচ্চিত্র মাধ্যমটির সব রকম প্রয়োগ কৌশল তাঁর আয়ত্তাধীন ছিল। তাঁর তৈরি সিনেমার নানা উল্লেখযোগ্য দিকের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো আবহসঙ্গীত। সিনেমার আদি যুগে আবহসঙ্গীত বলে কিছু ছিল না। ছবি দেখার সময় দর্শকের কানে আসতো প্রোজেক্টরের একটানা ঘরঘর আওয়াজ। এই একটানা শব্দ দর্শকের মনঃসংযোগের ব্যাঘাত ঘটাত। ক্রমে নির্বাক ছবির যুগেই এই শব্দদূষণ থেকে মুক্তির লক্ষে পিয়ানো বা অর্গান বাজানোর ব্যবস্থা চালু হয়। এই ব্যবস্থার দায়িত্ব থাকত প্রেক্ষাগৃহের বাদ্যকারদের উপর অর্থাৎ একই ছবি নানা প্রেক্ষাগৃহে নানা সুরের আবহসঙ্গীতের সঙ্গে দেখান হত। বিখ্যাত আমেরিকান পরিচালক ও প্রযোজক গ্রিফিথ এই ব্যবস্থায় খুশি না হয়ে একটি নতুন উপায় উদ্ভাবন করলেন তিনি ছবির সঙ্গে একটি স্বরলিপি  তৈরি করে দিতেন এবং সেইটি অনুসরণ করার কড়া নির্দেশ দিতেন। নির্বাক যুগের উল্লেখযোগ্য আবহসঙ্গীতের উদাহরণ হোল সের্গেই মিখাইলোভিচ আইজেনস্টাইনের ব্যাটলশিপ পটেমকিন (১৯২৫) ছবির জন্য করা জার্মান সুরকার এডমুন্ড মাইজেলের করা স্বরলিপি। আবহসঙ্গীত ক্রমশ বিবর্তিত হতে হতে সবাক যুগে ছবির সঙ্গে জুড়ে এখনকার যে পর্যায় সেই স্তরে উন্নীত হয়েছে । এখন এই বিষয়ে পরিচালকের দায়িত্ব অনেকখানি কারণ তিনি জানেন ছবির মেজাজ তুলে ধরতে আবহসঙ্গীতের গুরুত্ব অপরিসীম। আবহসঙ্গীত বিষয়ে সত্যজিৎ এক জায়গায় লিখেছেন “ দৃশ্যবস্তু ছাড়া ছবিতে যা থাকে তার মধ্যে প্রধান হলো সংলাপ ; কারণ কাহিনীর অনেকখানিই ব্যক্ত হয় সংলাপের মাধ্যমে। আরো কিছুটা বলা হয় যাবতীয় ধ্বনির সাহায্যে। এই বলার কাজে আবহসংগীতের কাজ সবচেয়ে পরে। কারণ সংগীতের ব্যঞ্জনা আছে , কিন্তু পরিষ্কার কোন ভাষা নেই। এখানে সাযুজ্যের একটা প্রশ্ন আসে। সব কথায় সব সুর বসে না । গান সেখানেই সার্থক যেখানে সুর হল ভাষার ব্যঞ্জক। চলচ্চিত্রের আবহসংগীতও ব্যঞ্জকেরই ভূমিকা গ্রহণ করে—যদি তা সুপ্রযুক্ত হয়”। …. “পথের পাঁচালি থেকে চারুলতা অবধি আবহসংগীতের নানান সমস্যার সামনে পড়তে হয়েছে আমাদের এবং সাধ্যমত সেগুলি সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে । পথের পাঁচালি ছিল গ্রাম্য পরিবেশের কাহিনী। কিন্তু তা বলে তা লোকসাহিত্য নয়। তার ভাষায়, তার মেজাজে রীতিমত sophistication আছে । তার চরিত্রবর্ণনে আধুনিক মনস্তাত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ আছে।  ছবিতেও অনুরূপ sophistication আনবার চেষ্টা করা হয়েছিল। সুতরাং এর আবহসংগীতে কেবলমাত্র গ্রাম্য যন্ত্রে গ্রাম্য সুর বাজানোর কোন সার্থকতা আছে বলে আমরা মনে করিনি। বাঁশি, গুপীযন্ত্র, ঢোল ইত্যাদির সঙ্গে সেতার সরোদ পাখোয়াজ মেশাতে তাই রবিশঙ্কর দ্বিধা করেননি।

তিন কন্যার ‘পোস্টমাস্টার’ও গ্রাম্য পরিবেশের ছবি। কিন্তু এর ভাব ভঙ্গী, এর কাহিনীর উপাদান, এর পাত্রপাত্রীর আচরণ ও কথাবার্তা – সবই ছিল অত্যন্ত সরল। তাই এর আবহসংগীতে বাঁশী, দোতারা ও সারিন্দা – এই তিনটি যন্ত্র ছাড়া আর কোন যন্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন বোধ করিনি।  জলসাঘরের বনেদি জমিদারি-মেজাজ  এ ছবির আবহসংগীতের চরিত্র  নির্ধারিত করেছিল। এই বিশেষ পরিবেশের সঙ্গে রাগসংগীতের একটা ঐতিহাসিক যোগসূত্র রয়েছে , এবং সে—যোগসূত্র সম্পর্কে আমরা সকলেই সচেতন। সুরকার বিলায়েৎ খাঁ সেতার সুরবাহার সরোদ সারেঙ্গী প্রভৃতি যন্ত্রে খানদানী রাগরাগিণী এ ছবিতে অত্যন্ত নিপুণভাবে ব্যবহার করেছিলেন ”। … “আসল কথা, সুরকারকে মনে রাখতে হবে যে তাঁর আনুগত্য প্রধানত চলচ্চিত্রের প্রতি , সংগীতশাস্ত্রের প্রতি নয়”। তিনি আরো বলেছেন “আজ অবধি যে—ক’টা ছবিতে আমি  নিজে সংগীত রচনার দায়িত্ব নিয়েছি তার মধ্যে চারুলতার সংগীত আমার কাছে অপেক্ষাকৃত সাবলীল ও সুপ্রযুক্ত বলে মনে   হয়েছে। এর একটা কারণ অবিশ্যি অভিজ্ঞতা। আবহসংগীতের কাজে অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক। ছবির মেজাজ সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকলেও কোন দৃশ্যে কোন বা কোন কোন যন্ত্রে কোন সুর কোন লয়ে কোন তালে বাজালে সেই মেজাজের সঙ্গে মিলবে , এ জ্ঞান সহজলভ্য নয়। তাই সংগীতের  কাজে এখনও অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে যায়। শেখারও আছে এখনও অনেক  কিছুই ”। আবহসংগীত বিষয়ে উনি আর একটি মুল্যবান কথা বলেছেন “এই দ্রুত পরিবর্তনের যুগে সিনেমাশিল্প সম্বন্ধে কোন চূড়ান্ত মন্তব্য করা অবশ্যই চলে না, তবে একটা কথা বেশ জোর দিয়েই বলা চলে যে, ভারতবর্ষে আবহসংগীত রচয়িতার সমস্যা দৈন্যের সমস্যা নয়, সেটা হল প্রাচুর্যের সমস্যা”।

সত্যজিৎ রায় একজন সফল প্রথম শ্রেণির তথ্যচিত্র নির্মাতাও । তাঁর তৈরি ‘রবীন্দ্রনাথ’  (১৯৬১),  ‘The Inner Eye’(১৯৭২), ‘বালা’ (১৯৭৬), ‘সুকুমার রায়’ (১৯৮৭) ও ‘সিকিম’ (১৯৭১) তথ্যচিত্রগুলি আমাদের দেশে নির্মিত সেরা তথ্যচিত্রগুলির অন্যতম। তাঁকে নিয়ে অন্যান্য চিত্র-পরিচালকেরা এক ডজনের বেশি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। চলচ্চিত্র ছাড়াও আরও অনেক বিষয়ের তিনি এক অবিস্মরণীয় শিল্প ।   ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট–এর চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ মারী সীটন তাঁকে নিয়ে ‘The Portrait of A Director’ নামের বই লিখেছেন।  দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছর একের পর এক অসাধারণ সব চলচ্চিত্র নির্মাণ , সাহিত্য রচনা সহ তাঁর সমগ্র সৃজনশীল কাজ আমাদের কাছে এক পরম বিস্ময়। ভারতরত্ন সহ দেশে-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত সত্যজিৎ রায় ১৯৯২ সালে অস্কার পুরস্কারে ভূষিত হন। শিল্প- সংস্কৃতির পীঠস্থান যে ফরাসি  দেশ সেই দেশের  সরকার সে-দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘লিজিওন দ্য’নর’ পুরষ্কারে তাঁকে ভূষিত করেছেন।  তিনি আমাদের গর্ব তিনি  সত্যজিৎ রায়।

১৯৫৫ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত তিনি মোট ছত্রিশটি ছবি নিজের পরিচালনায় করেছেন যার ২৯ টি কাহিনী চিত্র , ৫ টি তথ্যচিত্র এবং ২ টি শর্ট ফিল্ম । এছাড়াও অন্যান্য পরিচালকদের ছবিতে তিনি নানা ধরণের কাজ করেছেন। এই অন্যান্য পরিচালকদের মধ্যে জঁ রেনোয়া , হরিসাধন দাশগুপ্ত, বিজয়া মূলে , বংশী চন্দ্রগুপ্ত , টনি মেয়ার, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী , অভিষেক আয়েঙ্গার, সন্দীপ রায় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

সত্যজিৎ পরিচালিত ছবি ১) পথের পাঁচালী (১৯৫৫), ২) অপরাজিত (১৯৫৬), ৩) পরশ পাথর (১৯৫৮), ৪) জলসাঘর (১৯৫৮), ৫) অপুর সংসার (১৯৫৯), ৬) দেবী (১৯৬০), ৭) তিন কন্যা (১৯৬১), ৮) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৬১), ৯) কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৬২), ১০) অভিযান (১৯৬২), ১১) মহানগর (১৯৬৩), ১২) চারুলতা (১৯৬৪), ১৩) টু (১৯৬৪)/ নির্বাক ছবি,    ১৪) কালপুরুষ ও মহাপুরুষ (১৯৬৫), ১৫) নায়ক (১৯৬৬), ১৬) চিড়িয়াখানা (১৯৬৭), ১৭) গুপী গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৮), ১৮) অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৬৯), ১৯) প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০), ২০) সীমাবদ্ধ (১৯৭১), ২১) সিকিম (১৯৭১), ২২) The Inner Eye (১৯৭২), ২৩) অশনি সংকেত ( ১৯৭৩), ২৪) সোনার কেল্লা (১৯৭৪), ২৫) জন অরণ্য (১৯৭৫), ২৬) বালা (১৯৭৬), ২৭) শতরঞ্জ কে খিলাড়ি (১৯৭৭), ২৮) জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৯), ২৯) হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), ৩০) পিকু (১৯৮০)/ শর্ট ফিল্ম, ৩১) সদগতি (১৯৮১), ৩২) ঘরে বাইরে (১৯৮৪), ৩৩) সুকুমার রায় (১৯৮৭), ৩৪) গণশত্রু (১৯৯০), ৩৫) শাখা প্রশাখা (১৯৯০) ও শেষ ছবি  ৩৬) আগন্তুক (১৯৯১) ।

 

ঋণ স্বীকার: 

১। চলচ্চিত্রের অভিধান (বাণীশিল্প ) – ধীমান দাশগুপ্ত সম্পাদিত

২। গাস্তঁ রোবের্জ । 

৩। বিষয় চলচ্চিত্র: সত্যজিৎ রায়

৪। দেশ

Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

গন ভাইফোঁটার পরিকল্পনা নিয়েছে বসিরহাটের ‘নবোদয় সংঘ’

বনগাঁ থানার এবারের কালীপুজোর থিম ‘ কৈলাস পর্বতে মহাদেব’

বাঁকুড়ার সাঁতরা বাড়ির “বড় বৌমা” পূজিত হলেন মা কালীর রূপে

নৈহাটির বড়মার পুজোয় ভক্তদের ভিড়

তারাপীঠে সারারাত খোলা থাকছে গর্ভ গৃহের দরজা

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রয়েছেন উপবাস, নিজের হাতে রান্না করলেন ভোগ

Advertisement
এক ঝলকে
Advertisement

জেলা ভিত্তিক সংবাদ

দার্জিলিং

কালিম্পং

জলপাইগুড়ি

আলিপুরদুয়ার

কোচবিহার

উত্তর দিনাজপুর

দক্ষিণ দিনাজপুর

মালদা

মুর্শিদাবাদ

নদিয়া

পূর্ব বর্ধমান

বীরভূম

পশ্চিম বর্ধমান

বাঁকুড়া

পুরুলিয়া

ঝাড়গ্রাম

পশ্চিম মেদিনীপুর

হুগলি

উত্তর চব্বিশ পরগনা

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা

হাওড়া

পূর্ব মেদিনীপুর